খেলাচ্ছলে পড়া নয়, ঘর না জোটায় পড়া খেলার মাঠেই
যে মাঠে খেলা, সেই মাঠেই পড়া! দুপুরে যা স্কুল, বিকেলে সেটাই খেলার মাঠ।
মাথার উপরে ছাদ বলতে দু’টি পুরনো ক্ষিরীশ গাছের ছায়া। আর পলিথিন। গরমের দিনে রোদ্দুর ঘুরে গেলে পিঠ বাঁচাতে জায়গা বদল।
শিক্ষার অধিকার আইনে আগামী মার্চের মধ্যে ৬ থেকে ১৪ বছরের প্রতিটি পড়ুয়ার জন্য বাড়ির কাছাকাছি স্কুল থাকতেই হবে। তাতে থাকতে হবে ক্লাসঘর, ছেলে ও মেয়েদের শৌচাগার, পাঁচিল। অথচ হাওড়ার পাঁচলায় খোলা মাঠেই বছরের পর বছর চলছে খালপাড় দেশবন্ধু শিশুশিক্ষা কেন্দ্র।
মাঠের বুক চিরে চলে গিয়েছে রাস্তা। গ্রামবাসী চলাচল করছেন। অবিরাম যাচ্ছে সাইকেল-মোটরবাইক। তার মধ্যেই রাস্তার দু’দিকে মাঠে পলিথিন পেতে চলছে পঠনপাঠন। প্রথম থেকে চতুর্থ শ্রেণির জন্য চিহ্নিত রয়েছে আলাদা আলাদা জায়গা। তাতেই বসেছে সাহিদ জমাদার, কৃষ্ণা সাঁতরা, অর্পিতা নস্করেরা। অবশ্য শিক্ষিকাদের জন্য চেয়ার আছে। আর টেবিলে ঠেস দিয়ে মাঠে দাঁড় করানো ব্ল্যাকবোর্ড। দরকারে হাঁটু গেড়ে বসে শিক্ষিকারা তাতে খড়ির দাগ দেন।
কিন্তু শিক্ষিকার সংখ্যাও যে নিতান্তই অপ্রতুল। আইন অনুযায়ী যেখানে গড়পড়তা জনা তিরিশ পড়ুয়া পিছু এক জন শিক্ষিকা থাকা জরুরি, এখানে তিন শিক্ষিকার হেফাজতে রয়েছে ১৯৩ জন ছাত্রছাত্রী। অর্থাৎ অনুপাত কার্যত ৬৪:১। মজার কথা, ২০০২ সালে যখন কেন্দ্রটি খোলা হয়, ৩০ জন পড়ুয়াকে নিয়ে শুরু করেছিলেন এক শিক্ষিকা। পরে শিক্ষিকার সংখ্যা বেড়েছে, কিন্তু তার চেয়েও লাফিয়ে বেড়েছে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা। শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে তিন জনের বেশি শিক্ষিকা দেওয়ার চলও নেই। পশ্চিমবঙ্গ শিশুশিক্ষা মিশনের অধিকর্তা গৌতম ভট্টাচার্যের বক্তব্য, “স্কুলঘর না থাকার এই সমস্যা সারা রাজ্যে রয়েছে। যাঁদের বাড়ি নেই তাঁরা ক্লাবঘরে বা অন্য কারও দাওয়ায় স্কুল চালান। কিন্তু খোলা মাঠে চলা স্কুলে এত ছাত্রছাত্রী! এটা যথেষ্ট বিরল।”
এ ভাবেই রোজ ক্লাস করে পাঁচলা দেশবন্ধু শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের পড়ুয়ারা। ছবি: সুব্রত জানা।
বিরল হলেও আশ্চর্যের নয়। মাইলখানেকের মধ্যে প্রাথমিক স্কুল না-থাকাতেই এক দশক আগে এই শিশুশিক্ষাকেন্দ্র গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন গ্রামবাসী। রাজ্য পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন দফতর সেটিকে স্বীকৃতি দেয়। যথাসময়ে মিড-ডে মিল চালু হয়েছে। ছাত্রছাত্রীদের ইউনিফর্ম কেনার টাকাও দেওয়া হয়। গ্রামবাসীর একটা বড় অংশের মতে, মাথার উপরে ছাদ না থাকলেও পড়াশোনা হয় বেশ ভাল। তাই তাঁরা বাচ্চাদের পাঠান। নিয়মিত হাজিরা যথেষ্ট। কোনও স্কুলছুট নেই। চার বছর পড়া শেষে বেশির ভাগ পড়ুয়া মাইলখানেক দূরে আজিম মোয়াজ্জেম হাইস্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়।
কিন্তু ছাত্রছাত্রী ও অভিভাবকদের উৎসাহ রয়েছে মানেই তো এই নয় যে সব ঠিক চলছে। প্রধান শিক্ষিকা সবিতা দে-র আক্ষেপ, “গ্রীষ্মে খুব অসুবিধা। যেখানে পলিথিন পাতা, কিছু ক্ষণ পরে হয়ত রোদ চলে এল। ছায়ায় সরাতে হল পলিথিন। এ ভাবে মাঠ জুড়ে ঘুরতে থাকে পড়ুয়ারা।” বর্ষার আবার অন্য সমস্যা। সবিতাদেবী বলেন, “বৃষ্টি নামলে সব কিছু গুটিয়ে-পাটিয়ে উঠে যেতে হয় কারও বাড়িতে। যত ক্ষণ না থামে, বসে থাকো!”
কেন্দ্রটি চালু হওয়ার সময়ে গ্রামের এক জন জমি দেবেন বলেছিলেন। পরে তাঁর পরিবারের কয়েক জনের মধ্যে মতবিরোধ হওয়ায় সেই জমি আর মেলেনি। পরে আরও এক জন জমি দেন। গ্রামবাসী শঙ্কর সানা, প্রতিমা সাঁতরা, শেখ নেসার আলিদের প্রশ্ন, “নতুন যে জমি পাওয়া গিয়েছে, তাতে স্কুলবাড়ি হচ্ছে না কেন?” পাঁচলা ব্লক প্রশাসন সূত্রের খবর, স্কুলবাড়ি তৈরির জন্য ৬ লক্ষ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ হয়েছে। কিন্তু যে জমি মিলেছে, গলদ তাতেই।
পাঁচলা পঞ্চায়েত সমিতির শিক্ষা কর্মাধ্যক্ষ হাফিজুর রহমান বলেন, “আমরা একাধিক বার জমিটি সমীক্ষা করেছি। জমির অনেকটা অংশই পুকুরপাড়ের মধ্যে রয়েছে। গ্রাম পঞ্চায়েতকে বলেছি, ১০০ দিন কাজের প্রকল্পে পাড়টি বাঁধিয়ে দেওয়া হলে বাড়ি তৈরির কাজে হাত দেওয়া যেতে পারে।” পাঁচলা পঞ্চায়েতের প্রধান তারক রায়ের দাবি, “১০০ দিনের প্রকল্পে ওই পাড় বাঁধানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে।”
ঘটনা হল, জেলা তথা রাজ্যের অনেক জায়গাতেই একই ধরনের সমস্যা রয়েছে। হাওড়া জেলা পঞ্চায়েত ও গ্রামোন্নয়ন আধিকারিক শুভ্রজ্যোতি ঘোষ বলেন, “জমি বা অন্য সমস্যার কারণে জেলায় কিছু শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে বাড়ি করা যায়নি। তাদের বাড়ি তৈরির জন্য যে টাকা দেওয়া হয়েছিল, তা ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। জমি জোগাড় হলে ফের টাকা দেওয়া হবে।” রাজ্য শিশুশিক্ষা মিশনের অধিকর্তার সংযাজন, “শিক্ষার অধিকার আইনের সময়সীমা পেরনোর আগে সব সমস্যা দূর করার জন্য আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.