ভাঙড়ে মার খেয়ে দাঁত ভাঙল রেজ্জাকের
রাস্তায় ফেলে রড-লাঠি, অভিযুক্ত সেই আরাবুল
ক’দিন আগে ছিল উদ্দাম জলসা। এ বার রক্তারক্তি! রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী তথা বর্ষীয়ান বিধায়ককে রাস্তায় ফেলে মার। ফের অকুস্থল ভাঙড়!
প্রাক্তন ভূমিমন্ত্রী তথা সিপিএমের বিধায়ক আব্দুর রেজ্জাক মোল্লাকে মারধরের ঘটনায় নাম জড়িয়ে গেল ভাঙড়ের প্রাক্তন তৃণমূল বিধায়ক আরাবুল ইসলামের। সেই আরাবুল, যিনি ভাঙড় কলেজের এক শিক্ষিকাকে জগ ছুড়ে মারার অভিযোগে গত এপ্রিলেই সংবাদ শিরোনামে ছিলেন। এ বারের ঘটনাস্থলও ভাঙড় বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। রবিবার দুপুরে যেখানে আক্রান্ত হয়েছেন ক্যানিং (পূর্ব) কেন্দ্রের বিধায়ক তথা সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য রেজ্জাক। তাঁকে রাস্তায় ফেলে রড দিয়ে পেটানো হয়েছে এবং মেরে দাঁত ভেঙে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। আপাতত তিনি বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি।
পঞ্চায়েত ভোটের আগে এই ঘটনাকে স্বভাবতই তৃণমূলের বিরুদ্ধে হাতিয়ার করতে চাইছে সিপিএম। রেজ্জাকের উপরে হামলার ঘটনায় অভিযুক্ত আরাবুলকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে গ্রেফতার করা না-হলে আলিপুরে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা প্রশাসনিক ভবনের (পুলিশ সুপার, জেলাশাসকের দফতর) সামনে অবস্থানের হুমকি দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র। তাঁর আরও সংযোজন, “দরকার হলে অনশনেও বসব।” জেলা জুড়ে প্রতিবাদ-অবরোধ কর্মসূচির কথা বলেছেন দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সিপিএমের সম্পাদক সুজন চক্রবর্তী। গোটা রাজ্যে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে বামফ্রন্ট এবং সিপিএমের কৃষক সভাও।
ঘটনার প্রতিবাদ অবশ্য এ দিনই শুরু হয়েছে। ভাঙড় ১ ও ২ ব্লকের নানা জায়গায় সিপিএমের অবরোধ তুলতে গিয়ে ইটের ঘায়ে জখম হন ছ’জন পুলিশ কর্মী। সকলকে হাসপাতালে পাঠাতে হয়েছে। আটক করা হয়েছে ৮ সিপিএম কর্মীকে। অবরোধ করা হয় কলকাতা, উত্তর ২৪ পরগনা ও হুগলির একাধিক জায়গাতেও। ঘটনার প্রতিবাদে দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় বন্ধ পালনের দাবি উঠলেও সিপিএমের রাজ্য কমিটির সদস্য কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় জানান, সাগর মেলার কথা মাথায় রেখে আপাতত বন্ধ হচ্ছে না।

আহত আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। কলকাতার একটি হাসপাতালে, রবিবার। —নিজস্ব চিত্র

আরাবুলের পাশে দাঁড়িয়ে তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য দাবি করেছেন, রেজ্জাক নাটক করছেন! সিপিএম নিজেরাই নিজেদের কার্যালয় পুড়িয়ে উত্তেজনা ছড়াচ্ছে! রাজ্যের পুর ও নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের মন্তব্য, “বিষয়টা অত গুরুতর কিছু নয়! উনি (রেজ্জাক) হাসপাতালে শুয়ে নাটক করছেন।” তাঁর যুক্তি, “ওখানে আমাদের সভা চলছিল। রেজ্জাক মোল্লা সেখানে জোর করে ঢোকার চেষ্টা করেন। তখন ধস্তাধস্তি হয়।” ধস্তাধস্তির ঘটনায় সকলকে ধরতে গেলে রেজ্জাককেও গ্রেফতার করতে হয় বলে বোঝাতে চেয়েছেন ফিরহাদ। মন্ত্রীর কটাক্ষ, “উনি নিজে থেকেই লাফিয়ে এসেছেন। আবার নিজে থেকেই লাফিয়ে গিয়ে হাসপাতালে শুয়ে পড়েছেন! সত্যি সত্যিই চার হাজার মানুষ ওঁর উপরে লাফিয়ে পড়লে ওঁকে আর হাসপাতালে যেতে হত না!” খোদ আরাবুলের দাবি, “আমাদের দলীয় কার্যালয়ে ভাঙচুর করেছিল সিপিএম। আমরা তার প্রতিবাদে সভা করছিলাম। সে সময়ে রেজ্জাকের গাড়ি ওখান দিয়ে যাচ্ছিল। সাধারণ মানুষ উত্তেজিত হয়ে হামলা চালিয়েছে। ৩৪ বছর বিধানসভায় দাঁড়িয়ে উনি মিথ্যা বলেছেন! আজও নাটক করছেন!”
পুলিশ সুপারকে জানিয়ে এবং নিরাপত্তার আশ্বাস পেয়েই রেজ্জাক ভাঙড়ে যান বলে দাবি করে সিপিএমের প্রশ্ন, তার পরেও প্রবীণ বিধায়ককে এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হল কেন? এসপি প্রবীণ ত্রিপাঠি বলেন, “উনি (রেজ্জাক) আমাকে জানিয়েছিলেন, এ কথা ঠিক। ওখানে কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স থানার ওসি সতীনাথ চট্টোপাধ্যায় বাহিনী নিয়ে ছিলেন। তাঁরাই প্রাক্তন মন্ত্রীকে উদ্ধার করে গাড়িতে তুলে দেন। রেজ্জাক মোল্লার উপরে হামলার অভিযোগের তদন্ত চলছে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর, গত ১ জানুয়ারি ভাঙড়ের কাঁটাতলায় তৃণমূলের একটি কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় অভিযোগ ছিল সিপিএমের বিরুদ্ধে। শনিবার রাতে ওই এলাকাতেই সিপিএমের একটি কার্যালয় আগুনে পোড়ে। এ বার অভিযুক্ত তৃণমূল।

কাঁটাতলায় এ দিন সকালে প্রতিবাদ সভা করে সিপিএম। তৃণমূলের ‘বাধা’য় সভা মাঝপথে থামাতে হয় বলে তাদের অভিযোগ। এর কিছু পরে সিপিএমের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলে এবং দলের কার্যালয়ে হামলার প্রতিবাদে কাঁটাতলায় সভা শুরু করে তৃণমূল। বেলা তখন প্রায় পৌনে ১২টা। সে সময়ে কাঁটাতলায় দলীয় কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে দেখা করতে পৌঁছন রেজ্জাক। তাঁর গাড়ি ঘিরে ধরেন তৃণমূলের কর্মী-সমর্থকেরা। অভিযোগ, গাড়ির কাচ ভাঙচুর করা হয়। পুলিশের কাছে করা অভিযোগে রেজ্জাকের গাড়ির চালক অমর ঘোষ দাবি করেছেন, প্রাক্তন মন্ত্রীকে গাড়ি থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামান আরাবুল। এলোপাথাড়ি চড়-ঘুষি মারতে থাকেন সত্তরোর্ধ্ব রেজ্জাককে। রেজ্জাকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী এবং গাড়ির চালকের উপরেও চলে মারধর। থানায় বসে অমরবাবুর অভিযোগ, “স্যারকে পাঞ্জাবি ধরে টেনে গাড়ি থেকে নামান আরাবুল। মারধর শুরু করেন। আমি ও দেহরক্ষী ঠেকাতে গেলে আমাদেরও মারেন। স্যারকে মাটিতে ফেলে রড দিয়ে পেটানো হয়।”

ভাঙচুর হওয়া গাড়ির সামনে কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র
ঘটনাস্থলেই ছিলেন কয়েক জন পুলিশকর্মী। তাঁরা এসে মারমুখী তৃণমূল কর্মী-সমর্থকদের হাত থেকে উদ্ধার করেন প্রাক্তন মন্ত্রী ও তাঁর সঙ্গীদের। রক্তাক্ত রেজ্জাককে ওই গাড়িতে তুলেই রওনা করিয়ে দেওয়া হয়। ইএম বাইপাস লাগোয়া বেসরকারি হাসপাতাল সূত্রের খবর, দু’টি দাঁত ভেঙেছে রেজ্জাকের। চারটি সেলাই পড়েছে মুখে। ঠোঁটও ফেটেছে। ঘাড়ে এবং কোমরে যন্ত্রণা রয়েছে। হাসপাতালের আধিকারিক সুজয় দেব জানান, প্রাক্তন মন্ত্রীর কোমরে এক্স-রে করানো হয়েছে। কিছু সমস্যা দেখা গিয়েছে। হাসপাতালে রেজ্জাককে দেখতে যান সূর্যবাবু, সুজনবাবু, কান্তিবাবু, বিকাশ ভট্টাচার্য, রবীন দেব প্রমুখ। রেজ্জাক বলেন, “আরাবুলরা জানত আমি যাব। পরিকল্পিত ভাবে হামলা চালিয়েছে।”
বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসু বলেন, ‘তৃণমূল গোটা রাজ্য জুড়ে যে কায়দায় নৈরাজ্য-বিশৃঙ্খলা চালাচ্ছে, এ দিনের ঘটনা তারই আর এক নমুনা।’ ডায়মন্ড হারবারে এ দিনই জেলা কৃষক সভার সমাবেশে আরাবুল প্রসঙ্গে সূর্যবাবুর কটাক্ষ, “ওঁর নাম মনে করতে গেলে মনীষীদের নাম ভুলে যাই!” সুজনবাবুর মন্তব্য, “যারা দলের প্রতিষ্ঠা দিবস মহিলাদের গায়ে টাকা ছুড়ে দেন, তাঁদের কাছ থেকে আর কী-ই বা আশা করা যায়!”
রেজ্জাকের উপরে আক্রমণের নিন্দা করে অবিলম্বে দোষীদের গ্রেফতার দাবি করেছেন পিডিএস নেতা সমীর পূততুণ্ড বা সিপিআই (এম-এল) লিবারেশনের পার্থ ঘোষ, কার্তিক পালেরা। রেজ্জাককে দেখতে আজ, সোমবার, হাসপাতালে যাওয়ার কথা রাজ্য বিজেপি সভাপতি রাহুল সিন্হার। প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেছেন, তৃণমূল যা করছে, সেটা বাংলার সংস্কৃতি নয়। তবে বাম জমানার শেষ দিকে মানস ভুঁইয়া-সহ কংগ্রেসের এক দল বিধায়কের উপরে সিপিএমের আক্রমণের কথাও মনে করিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ।
তবে ক্যানিংয়ে এ দিনই এক সভায় তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায় বলেছেন, “আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, রেজ্জাক মোল্লা আমাদের প্রতিবাদ সভায় এসে প্ররোচনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। তাঁকে মারধরের অভিযোগ মিথ্যা।”

ইনিই আরাবুল
বয়স: ৪৭
শিক্ষা: ২০০৬-এর বিধায়ক মনোনয়নপত্র অনুযায়ী রবীন্দ্র মুক্ত বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাশ।
রাজনীতি: দলের জন্মলগ্ন থেকে তৃণমূলে। বিধায়ক ২০০৬-’১১।
অভিযোগনামা
• ২০০৬-এ লেদার কমপ্লেক্স থানার ওসিকে মারধর। কোর্টে আত্মসমর্পণ। ৪০ দিন জেল হাজতে।
• ২০১২ সালের এপ্রিলে ভাঙড় কলেজের শিক্ষিকা দেবযানী দেকে জগ ছুড়ে মারা। ঘটনার তদন্ত চলছে।
মামলা ঝুলছে: মোট ৭টি (খুনের চেষ্টা, অপহরণ, তোলাবাজি)।
বিশেষ তথ্য: ২০১০ সাল থেকে ভাঙড় কলেজের পরিচালন সমিতির সভাপতি।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.