শীতের সীমান্তে বাড়ছে পাচার, হয়রানি
ভোর ভোরই মাঠে যাচ্ছিলেন হোগলবেড়িয়ার সুনীল মণ্ডল। কাঁটাতার পেরিয়ে ওপারের মাঠে চাষ করতে যাবেন। যেমন যান নিত্য। কিন্তু এ বার কুয়াশা ফুঁড়ে সামনে উপস্থিত দুই বিএসএফ জওয়ান। শীতকাল বলে একটি জ্যাকেটের উপরে বড় চাদর। সেই চাদরেই ঢাকা মুখ। সীমান্তরক্ষীরা তাঁর সেই চাদর খুলিয়ে জ্যাকেটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে তল্লাশি শুরু করলেন। শীতে কাঁপতে কাঁপতে সুনীলবাবু যতই কাতর স্বরে তাঁদের তাড়াতাড়ি তল্লাশি শেষ করতে বলেন, তাদের চোখও ততই রক্তবর্ণ হয়ে ওঠে। সন্ধ্যা বেলা ফেরার পথেও তাই। ভোটের কার্ড দেখিয়েও নিস্তার মেলে না। ঠকঠকানি শীতে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়, কত ক্ষণে তল্লাশি শেষ হবে। আসলে ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় সীমান্তও। কালবৈশাখীর ঝড় উঠলেই যেমন জলপাই রঙের পোশাক পরা বিএসএফ জওয়ানের হাতের রেডিও ট্রানজিস্টারে বেজে ওঠে--‘কড়া নজর রাখো, আজ গরু পার হতে পারে’। তেমনই অমাবস্যার রাতে গাছের ডালপালা ভেদ করে চার ব্যাটারি টর্চের তীক্ষ্ম আলো শূন্যে ঘোরাফেরা করলে চকিতে বুঝে নিতে হয়, এটা কীসের সঙ্কেত! আবার ভরা পাটের মরসুমে তরকাঁটার ওপারের পাটগাছ নড়ে উঠলে মুহূর্তেই আন্দাজ করে নিতে হয় ওটা নিছক বাতাসের সৌজন্যে নাকি ঘন, লম্বা পাটগাছের আড়ালে ওঁত পেতে রয়েছে অন্য কোনও বিপদ। তবে সব ঋতুকেই ছাপিয়ে যায় শীতকাল। বিএসএফ, প্রশাসন থেকে সাধারণ মানুষ সকলেই একবাক্যে মেনে নিচ্ছেন যে, সীমান্তের বারোমাস্যায় এটাই সব থেকে আতঙ্কের ঋতু। তাই শীতকালের কথা মাথায় রেখে এক দিকে সীমান্তে যখন জারি করা হয় অতিরিক্ত সতকর্তা। অন্য দিকে তখন তক্কে তক্কে থাকে চোরাপাচারকারীরাও। ফলে গোটা শীতকাল জুড়েই পৌষমাস ও সর্বনাশের সেই চেনা প্রবাদটা পাক খেতে থাকে সীমান্তের আনাচে কানাচে।

ডিল-জ্যাকেটও রয়েছে
সীমান্তরক্ষী বাহিনীই বা কী করবে, তার উত্তর মেলে না। কেননা, পোশাক নিয়ে বিএসএফের সন্দেহ যে সব সময় অমূলক, এমনটা ভাবলেও ভুল হবে। মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি, রানিনগর সীমান্তে কয়েক বছর ধরে ব্যাপক বিকিয়েছে ‘ডিল-জ্যাকেট’ (এক প্রকার কাশির ওষুধ। সীমান্ত এলাকায় যার ডাকনাম ‘ডিল’।) বিএসএফসূত্রে জানা গিয়েছে, ওই জ্যাকেটটি দেখতে আর পাঁচটা সাধারণ জ্যাকেটের মতোই। কিন্তু জ্যাকেটের ভিতরে রয়েছে অজস্র ছোট ছোট পকেট। যে পকেটগুলোতে অনায়াসে গলে যায় ওই ওষুধের বোতল। ফলে কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওই জ্যাকেটের মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে ওই ওষুধ। তবে শুধু ‘ডিল’ই নয়। মুর্শিদাবাদ, নদিয়ার সীমান্তে চাদর কিংবা জ্যাকেটের আড়ালে সহজে বয়ে নিয়ে যাওয়া যায় তেমন আরও অনেক কিছুই পাচার হওয়ার নজির রয়েছে।

সমঝে চলতে হয় কুয়াশাকে
এক শীতে রক্ষা নেই, দোসর কুয়াশা। পাচারকারীদের তাই এই সময়টা সোনায় সোহাগা। এক বিএসএফ কর্তার কথায়, ‘‘আবহাওয়ার খোঁজখবর সাধারণ মানুষের থেকে বেশি রাখে সীমান্তের পাচারকারীরা। রাতের দিকেই আভাস পাওয়া যায় কুয়াশা কেমন হবে। সেই ভাবেই ওরা অপারেশনের ছক করে নেয়। সতর্ক থাকি আমরাও। কিন্তু সবসময় শেষরক্ষা হয় না।” ওই কর্তার কথায়, “কুয়াশাকে সমঝে চলি আমরাও। কারণ কুয়াশার সঙ্গে মোকাবিলা করার মতো অত্যাধুনিক কোনও যন্ত্র আমাদের হাতে এখনও পর্যন্ত নেই। ঘন কুয়াশায় কাছের জিনিসও দেখা যায় না। আরও বিপজ্জনক হল, কুয়াশার মধ্যে কার্যত অচল হয়ে পড়ে বাইনোকুলার, এসএসটিআই কিংবা নাইট ভিশন ক্যামেরাও।” বিএসএফের এই অসহায়তার কথা খুব ভাল করেই জানে পাচারকারীরা। সেই কারণেই সারা বছর টুকিটাকি পাচার চললেও শীতকালে সেটা অনেকগুণ বেড়ে যায় বলেও কবুল করেছেন বিএসএফেরই এক কর্তা।

নদীতে জল কম থাকে
সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কথায়, পদ্মা হোক কিংবা মাথাভাঙা, শীত মানেই হাঁটুজল। বর্ষায় যে নদীর ভরসায় অনেকটাই নিশ্চিন্তে থাকে বিএসএফ কিংবা সীমান্তের মানুষ, সেই নদীই শীতকালে অন্যতম সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সীমান্তের যে সব এলাকায় এখনও পর্যন্ত তারকাঁটার বেড়া নেই সেখানে কার্যত সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করে নদীই। শীতে নদীতে জল কম থাকায় এক দিকে যেমন হাঁটুজল পেরিয়ে এপারে চলে আসে বাংলাদেশি দুষ্কৃতীরা, তেমনই নদী দিয়ে গরু পাচারও অনেকটা সহজ হয়ে যায়। রানিনগরের মহিউদ্দিন সরকার যেমন বলেন, “নদীতে জল থাকলে আমরাও অনেকটা নিশ্চিন্তে থাকি। বিএসএফ আছে ঠিকই কিন্তু নদীও অনেক ভরসা জোগায়। নদীতে জল থাকলে ওপার থেকে এপারে আসা অনেকটাই কঠিন। কিন্তু শীতে তো সেই জল থাকে না, ফলে নদী পেরিয়ে সীমান্ত পারাপারও এই সময় অনেক সহজ হয়ে যায়। সেই জন্য রাতবিরেতে একটা আতঙ্ক তো থেকেই যায়।”

বদলে যায় পাচারের কৌশল
ঋতুর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় পাচারের কৌশলও। বিএসএফসূত্রে জানা গিয়েছে, সীমান্তের যেখানে তারকাঁটার বেড়া নেই সেদিক দিয়েই শীতকালে গবাদি পশু পাচার বেশি হয়। কিন্তু যেখানে তারকাঁটা রয়েছে, সেখানে গুরুত্ব পায় কাশির ওষুধ ও গাঁজাও। কোনও প্যাকেটের মধ্যে কয়েক কেজি গাঁজা দিব্যি ছুঁড়ে ফেলা যায় কাঁটাতারের ওপারে। আর কাশির ওষুধ? বিএসএফ সূত্রে খবর, ডিল জ্যাকেটের পাশাপাশি এই শীতে কাশির ওষুধ পাচারের আর এক অভিনব উপায় বের করেছে পাচারকারীরা। পাচারের জন্য সে তারকাঁটার ওপারেও যাচ্ছে না, সীমান্তরক্ষীদের রাস্তাতেও উঠছে না। রাতের অন্ধকার, এমনকি কুয়াশাচ্ছন্ন দিনেও সে বেছে নিচ্ছে বর্ডার রোডের নীচের কোন কালভার্ট। কালভার্টের তলায় সে একটা প্রমাণ সাইজের পাইপ নিয়ে বসে যাচ্ছে। পাইপের মুখ থাকছে কাঁটাতারের ওপারে তারপর পাইপের এক মুখ দিয়ে সে একটা একটা করে কাশির ওষুধের বোতল ঢুকিয়ে দিচ্ছে আর অনায়াসে সেটা পৌঁছে যাচ্ছে ওপারে। দূর থেকে দেখলে বোঝার উপায় নেই যে সে পাচার করছে, নাকি খেতের কোনও কাজ করছে। ফলে নজর রাখতে হচ্ছে কালভার্টের তলাতেও।

বিএসএফের নিজস্ব সমস্যা
পরনে জলপাই রঙের পোশাক। কাঁধে ঝুলছে ইনসাস কিংবা এসএলআর। বর্ডার রোডের উপর দিয়ে হেঁটে গেলে কালো বুট থেকে ভারি আওয়াজ শোনা যায়। বছর কয়েক আগেও এই বিএসএফকে নিয়ে একটা কথা চালু ছিল সীমান্তে- বিএসএফ মনে করলে কাঁটাতারের উপর দিয়ে পাখিকেও উড়ে যেতে দেবে না। অথচ সেই বিএসএফকে পিছনে এখন অনেকে বলেন ‘নিধিরাম সর্দার’। নদিয়া সীমান্তের এক বিএসএফ কর্তার কথায়, “কী বলব বলুন? আমাদের গুলি চালানোর হুকুম নেই। পিএজি বলে আমাদের একরকম আগ্নেয়াস্ত্র দেওয়া হয়েছিল যা থেকে ছররা গুলি বেরোবে, কিন্তু তা গায়ে লেগে মারা যাওয়ার আশঙ্কা খুবই কম। পরে দেখা গেল কম দূরত্ব থেকে সেই গুলি লাগলে মারাও যেতে পারে। ফলে সেটাও কাজে দিল না। এখন ইনসাস, এসএলআর, এলএমজি, সদ্য ইতালি থেকে নতুন ধরনের কারবাইন এলেও আমাদের গুলি চালানোর নির্দেশ নেই। এটা যেদিন থেকে পাচারকারীরা জেনে গিয়েছে, সেদিন থেকে ওরাও বুঝে গিয়েছে যে আর যাই হোক মৃত্যু ভয় নেই।” ওই কর্তা বলেন, ‘‘তা ছাড়া বিএসএফকে এখন সীমান্ত পাহারার পাশাপাশি নির্বাচনের মতো বেশ কিছু বাড়তি দায়িত্ব সামলাতে হচ্ছে। এবার সেই কাজের জন্য সীমান্ত থেকেই তুলে নেওয়া হচ্ছে বিএসএফকে। ফলে প্রয়োজনের তুলনায় বিএসএফের ঘাটতি থাকছে। এমন অনেক ক্যাম্প রয়েছে যেখানে জওয়ান দরকার ৩৫ জন। অথচ রয়েছেন মাত্র ১৫ জন। এই অল্প সংখ্যক জওয়ানকে দিয়েই সব রকম কাজ করাতে হচ্ছে।”

সতর্ক প্রশাসনের কর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা
বিএসএফের পাশাপাশি সতর্ক থাকে পুলিশ প্রশাসনও। তা ছাড়া সীমান্ত এলাকার থানাগুলোকে স্বাভাবিক কারণেই নিয়মিত যোগাযোগ রাখতে হয় বিএসএফের সঙ্গেও। নদিয়ার পুলিশ সুপার সব্যসাচীরমণ মিশ্র বলেন, “শীত পড়তেই নজরদারি বাড়িয়েছে পুলিশও। জাতীয় ও রাজ্য সড়কের পাশাপাশি যে সব রাস্তা সীমান্তের দিকে চলে গিয়েছে, সেদিকেও রাতে চলছে নিয়মিত পুলিশি টহলদারি। শেষ বাসেও পুলিশ থাকছে।” ডোমকলের মহকুমাশাসক প্রশান্ত অধিকারী বলেন, “শীত ও কুয়াশায় সীমান্তের সমস্যা কোনও নতুন ঘটনা নয়। এই সময় পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। এই সময়ে পুলিশ ও বিএসএফের নজরদারিও অনেকগুণ বাড়ানো হয়। পাশাপাশি কোন সমস্যা হলে বিএসএফের সঙ্গে প্রশাসনের বৈঠকের মাধ্যমেও সেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা হয়।” মুর্শিদাবাদ লোকসভার সাংসদ কংগ্রেসের মান্নান হোসেনও মেনে নিয়েছেন, “নদিয়া কিংবা মুর্শিদাবাদ সীমান্তে গত কয়েক বছর ধরে পাচার অনেকটাই কমেছে। তবে শীতে পাচারকারীরা একটু বেশি সক্রিয় হয়ে ওঠে। বিশেষ করে রানিনগর ও জলঙ্গি সীমান্ত এলাকা নিয়ে। দিল্লিতে প্রায়ই আমাকে অভিযোগ শুনতে হয়। বিএসএফ ও প্রশাসনের সঙ্গেও আমি কথা বলব। বিএসএফেরও কোনও নিজস্ব সমস্যা থেকে থাকলে সেটাও সংসদে জানাব।” করিমপুরের বিধায়ক সিপিএমের সমরেন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, “শীতের সীমান্ত সব দিক থেকেই আতঙ্কের। এই সময়ে পাচার একটু বেড়ে যায়। গত কয়েকদিনে হোগলবেড়িয়া থানা এলাকা থেকে বেশ কয়েকটি গরু, মোষ চুরিও গিয়েছে। তবে পাচার রুখতে বিএসএফের পাশাপাশি আরও সতর্ক হওয়া উচিত পুলিশ প্রশাসনেরও।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.