মানুষের শরীরে ওষুধের পরীক্ষানিরীক্ষা চালানোর ক্ষেত্রে বহুজাতিক ওষুধ সংস্থার উপরে নিয়ন্ত্রণ আনতে ব্যর্থ হওয়ায় কেন্দ্রের কড়া সমালোচনা করল সুপ্রিম কোর্ট। বৃহস্পতিবার তারা নির্দেশ দিয়েছে, এ বার থেকে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যসচিবের তত্ত্বাবধানে কড়া নজরদারির মধ্যে সমস্ত ‘ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল’ বা পরীক্ষা চালাতে হবে।
বাজারে বিক্রির ছাড়পত্র পাওয়ার আগে প্রতিটি ওষুধেরই ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল বা মানুষের শরীরে তার প্রতিক্রিয়ার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক। ওই পরীক্ষায় বোঝা যায়, ওষুধের কোনও ক্ষতিকর প্রভাব আছে কি না। কিন্তু যে-পদ্ধতিতে ওই পরীক্ষানিরীক্ষা হচ্ছে, তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছে সর্বোচ্চ আদালত। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা শীর্ষ আদালতে অভিযোগ করেছিল, বেশ কিছু বহুজাতিক সংস্থা গরিব মানুষকে গিনিপিগের মতো ব্যবহার করছে। পরীক্ষায় অনেকের প্রাণও যাচ্ছে। এর বিহিত করার আবেদন জানায় ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা।
কেন্দ্রের কাছে বিচারপতি আর এম লোঢা এবং বিচারপতি এ আর দাভের ডিভিশন বেঞ্চের প্রশ্ন, বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থা অবাধে তাদের ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চালাচ্ছে কী ভাবে? আদালতের মন্তব্য, এর জেরে প্রাণ যাচ্ছে বহু মানুষের। কিন্তু সরকার উদাসীন। এই চক্র ভাঙার জন্য যথাযথ প্রক্রিয়া চালু করার ক্ষেত্রেও সরকারের নীরবতা তাদের বিস্মিত করেছে বলে মন্তব্য করেছে সর্বোচ্চ আদালত। স্বাস্থ্য মন্ত্রকের কর্তাদের উদ্দেশে বিচারপতিদের মন্তব্য, “জনসাধারণের জীবন রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের। অবাধ পরীক্ষানিরীক্ষার ফলে প্রাণহানি বন্ধ করতে হবে। দ্রুত ব্যবস্থা নিন।”
কেন্দ্রের স্বাস্থ্যকর্তারা জানান, ওষুধ নিয়ে পরীক্ষার নানা বিষয় দেখার জন্য তাঁরা একাধিক কমিটি গঠন করেছেন। সেই সব কমিটির পরামর্শ জেনে তাঁরা তা আদালতে পেশ করবেন। শুনেই বিচারপতিরা বলেন, “কমিশন বা কমিটি গড়ে দৃষ্টি অন্য দিকে ঘোরানোর চেষ্টা করে লাভ নেই। আপনারা ফের আদালতে আসার সুযোগ পাবেন। কিন্তু যাঁদের জীবনটাই চলে গিয়েছে, তাঁদের পরিবারের কী হবে?”
মানবশরীরে ওষুধের পরীক্ষা চালানোর ব্যাপারে বিভিন্ন রাজ্যের ভূমিকা কী, তা-ও জানতে চেয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। অবিলম্বে সব রাজ্যে এ বিষয়ে নোটিস জারি করতে বলা হয়েছে। রাজ্য সরকারগুলি কী ব্যবস্থা নিচ্ছে, আট সপ্তাহ পরে তা কোর্টকে জানাতে হবে মুখ্যসচিবদের মাধ্যমে। এখনই যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের উপরে নজরদারি বাড়ানো দরকার, তা স্বীকার করেন রাজ্যের ড্রাগ কন্ট্রোলের কর্তারাও। তাঁদের বক্তব্য, ওষুধের বাজারে প্রতিযোগিতা যে-হারে বাড়ছে, যে-ভাবে নিত্যনতুন ওষুধ বাজারে আসছে, তাতে প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলি মরিয়া হয়ে উঠেছে। সরকার কড়া না-হলে গরিবদের উপরে ওষুধের যথেচ্ছ প্রয়োগ ঠেকানো যাবে না।
স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দায়ের করা জনস্বার্থের মামলায় অভিযোগ করা হয়, বিভিন্ন রাজ্যে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নামে যথেচ্ছাচার চালাচ্ছে কিছু বহুজাতিক সংস্থা। ইনদওরে একটি বহুজাতিক সংস্থা নতুন ওষুধ বাজারে ছাড়ার আগে ৩৩০০ মানুষের উপরে তার পরীক্ষা চালিয়েছিল। তার সঙ্গে জড়িত ছিলেন সরকারি হাসপাতালের ১৫ জন এবং বেসরকারি হাসপাতালের ৪০ জন চিকিৎসক। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের জেরে ২০০৮ সালে সেখানে ২৮৮ জন, ’০৯ সালে ৬৩৭ এবং ’১০ সালে ৫৯৭ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে আদালতে। সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রকে সব তথ্যপ্রমাণ পেশ করার নির্দেশ দেয়। ওষুধের ওই সব পরীক্ষায় কী ধরনের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ঘটেছে, ক’জনের প্রাণ গিয়েছে, কাউকে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছে কি না সবই জানাতে বলা হয়।
মধ্যপ্রদেশ সরকার জানিয়ে দেয়, এ ব্যাপারে তাদের কিছু করণীয় নেই। কারণ, ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের অনুমতি দেয় কেন্দ্র। সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, দায় এড়ানো চলবে না। ওই সব পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে বিভিন্ন সরকারি হাসপাতালে। আর সেই সব হাসপাতাল কেন্দ্রের নয়, রাজ্যের অধীনে। এ দিন আদালত জানায়, শুধু বিশেষ কোনও রাজ্য নয়, দেশের সর্বত্রই ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের উপরে নজরদারি চালু করতে হবে কেন্দ্রকে। |