বারাসত-কাণ্ড ঘিরে দেখা দিয়েছে নতুন বিভ্রান্তি। বিভ্রান্তির কারণ, পুলিশের সঙ্গে চিকিৎসকদের বক্তব্যের ফারাক। সেই সঙ্গে রক্তের উৎস নিয়ে ধন্দ।
বারাসতে খুন হওয়া মহিলার স্বামীর শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে ডাক্তারেরা পুলিশকে যে গোপন রিপোর্ট পাঠিয়েছেন, সেখানে অ্যাসিডে পোড়ার কথা বলা হয়নি বলে বৃহস্পতিবার দাবি করেছে সিআইডি। যদিও আরজিকর হাসপাতালের চিকিৎসকেরা এ দিনও স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, অ্যাসিডে পোড়েনি এমন কথা তাঁরা রিপোর্টে লেখেননি। বরং চিকিৎসকদের বক্তব্য: ওই প্রৌঢ়ের মুখ থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত ক্ষত রয়েছে। তাই কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাচ্ছে না।
গত শনিবার বারাসতের জগন্নাথপুরে সোনাখড়কি গ্রামের এক ইটভাটার মধ্যে আক্রান্ত হয়েছিলেন বছর পঁয়তাল্লিশের গৃহবধূটি। অভিযোগ, দুষ্কৃতীরা তাঁকে ভাটা-লাগোয়া পুকুরের পাশে টেনে নিয়ে যায়, বাধা দিতে গিয়ে তাঁর স্বামী প্রহৃত হন। পরে ওখানে মহিলার দেহ উদ্ধার হয়। নিহতের ছেলের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ খুন ও ধর্ষণের মামলা রুজু করে, তদন্তে নামে সিআইডি। কিন্তু মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কি না, পুলিশ সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি। তদন্তকারীদের বক্তব্য, ফরেন্সিক রিপোর্ট না-পেলে তা বলা সম্ভব নয়।
এ দিকে ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী, অর্থাৎ মহিলার স্বামীকেও গোয়েন্দারা ঠিকঠাক ভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারছেন না। আরজিকরে চিকিৎসাধীন ওই ব্যক্তি এখনও ভাল ভাবে কথা বলার অবস্থায় নেই বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। প্রৌঢ়ের অভিযোগ: দুষ্কৃতীরা তাঁকে জবরদস্তি অ্যসিড খাইয়ে দিয়েছিল। তাঁর শরীরের ভিতরে ক্ষত থাকার কথা ডাক্তারেরাও বলেছেন। এখন প্রশ্ন, ক্ষতটা কীসের? তাঁর গলা, খাদ্যনালী, পাকস্থলী কি অ্যাসিডেই পুড়েছে?
হাসপাতাল-কর্তৃপক্ষের ব্যাখ্যা: ‘ক্লিনিক্যালি’ দেখে এমনটাই মনে হয়েছে। “বার বার রক্তবমি হচ্ছিল। বলছিলেন, জিভ, গলা জ্বলে যাচ্ছে। অ্যাসিডের তেজে যা হয়ে থাকে। তাই ওঁকে আইটিইউয়ে ভর্তি করা হয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে মনে হয়েছে, ক্ষতের যা অবস্থা, সামান্য ধাক্কা লাগলে খাদ্যনালী বা পাকস্থলী ফুটো হয়ে টানা রক্তবমি শুরু হতে পারে। তাই এন্ডোস্কোপি বা অন্য কোনও পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা যাচ্ছে না।” বলেন হাসপাতালের এক কর্তা। বস্তুত ওঁকে মুখ দিয়ে জলও খাওয়ানো যাচ্ছে না। ঢোকানো যাচ্ছে না রাইল্স টিউব। ওঁর চিকিৎসায় গত সোমবার তিন বিশেষজ্ঞের মেডিক্যাল বোর্ড তৈরি হয়েছে, যাতে রয়েছেন ক্রিটিক্যাল কেয়ারের সুগত দাশগুপ্ত, মেডিসিনের নবেন্দু কারজি ও ফরেন্সিক অ্যান্ড টক্সিকোলজি’র শোভন দাস।
নিহতের স্বামীর গায়ে লেগে থাকা রক্ত নিয়েও বিভ্রান্তি অনেক। কী রকম?
পুলিশি তদন্তে প্রকাশ, ঘটনার দিন তাঁর পরনে থাকা জ্যাকেট-সোয়েটারে রক্তের চিহ্ন মিলেছে। বাড়ির লোকেরও দাবি, সে দিন উনি ‘রক্তাক্ত’ অবস্থায় বাড়ি ফিরে স্ত্রীর বিপদের কথা জানিয়েছিলেন। এ দিকে ডাক্তারেরা বলছেন, ওঁর শরীরে এমন কোনও ক্ষত নেই, যা থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে! এতেই ধন্দে পড়েছেন তদন্তকারীরা। প্রশ্ন উঠছে, তা হলে ওঁর পোশাকে রক্ত এল কী ভাবে?
পুলিশ-সূত্রের খবর: চিকিৎসাধীন ওই ব্যক্তির শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়ে একাধিক প্রশ্ন ডাক্তারদের লিখিত ভাবে পাঠানো হয়েছিল। পুলিশের দাবি: সে প্রশ্নের উত্তরে চিকিৎসকেরা জানিয়েছিলেন, ওঁকে জোর করে অ্যাসিড কিংবা বিষ জাতীয় কিছু খাওয়ানো হয়নি, শরীরেও কোনও চিহ্ন মেলেনি। অবশ্য, প্রাথমিক রিপোর্টে আরজিকরের ডাক্তারেরাই জানিয়েছিলেন, অ্যাসিড বা বিষ খাওয়ানোর ফলে ওঁর মুখ-খাদ্যনালী-পাকস্থলীতে সংক্রমণ হয়েছে। যে বক্তব্য থেকে এ দিনও সরে আসেননি তাঁরা। অতএব বিভ্রান্তি থেকেই যাচ্ছে। তবে তদন্তকারীরা সে সব কাটিয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা সুসংহত জায়গায় পৌঁছতে চাইছেন। এ দিন সিআইডি-অফিসারেরা ফের ঘটনাস্থলে গিয়ে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলেন। ঘটনার পুনর্নির্মাণও করা হয়। |