ওয়াঘা-যুদ্ধ
রজতজয়ন্তী ম্যাচে ফিরল
ছিয়ানব্বইয়ের সেই অভিশপ্ত রাত
সেই যুগ আর নেই। ড্রেসিংরুমে আগের মতো এখন আর মিডিয়ার ঢোকার উপায় নেই। তাই তুলনা করার উপায় নেই তেইশ বছর আগের গদ্দাফির পাক ড্রেসিংরুম আর বিষ্যুদবার সিরিজ জিতে ওঠা ইডেনের পাক ড্রেসিংরুমে কতটা মিল!
তেইশ বছর আগে গদ্দাফিতে হওয়া সেই ম্যাচেও খেলেননি সচিন তেন্ডুলকর। আসলে বাদ পড়েছিলেন। সচিনের জীবনে একমাত্র বাদ পড়া। প্রথম ব্যাট করে ইমরানের পাকিস্তান আশ্চর্যজনক ভাবে অল আউট হয়ে যায় ১৫০। সবাই জানত সিরিজ ১-১ হয়ে যাচ্ছে। ভারত আরও আশ্চর্য করে ১১২ অল আউট হয়ে যায়। আজহার-কপিল সমৃদ্ধ সেই টিমের ভেঙে পড়ার চেয়েও চরম বিস্ময়কর কিছু দেখেছিলাম পাক ড্রেসিংরুমে ঢুকে। সঈদ আনওয়ার থেকে আবদুল কাদির একটা বড় গ্রুপ নির্বিকার বসে হিসেব করছিল, তাদের রোজগারের টাকাগুলো কী ভাবে কোথায় রাখা যায়। আমাদের এখানে যেমন ইন্দিরা বিকাশ পত্র বা এনএসসি। পাক পোস্ট অফিসেও তেমনই লগ্নির নানা রকম স্কিম আছে। কোথায় রাখলে বেশি সুদ পাওয়া যায়, সেই আলোচনায় এর পর যোগ দিতে এগিয়ে এসেছিলেন মিয়াঁদাদ। একজনের মুখেও এমন অবশ্যম্ভাবী হারা ম্যাচ থেকে উদ্ধারের কোনও উত্তেজনা প্রকাশ পায়নি।
আসলে তত দিনে ভারতকে হারানোটা পাকিস্তানের কাছে এমন জলভাত হয়ে গিয়েছে যে ভেন্যু শারজা হোক বা লাহৌর, স্কোরের কোনও হেরফের হওয়ার উপায় নেই। এ দিনের ইডেনে ম্যাচ জেতার পরে পাকিস্তানিদের উল্লাস প্রকাশের ধরন দেখে আশঙ্কা হচ্ছিল, পাক-ভারত ক্রিকেট কি আবার সেই যুগে ফেরত গেল? যেখানে ভারতের হারাটাই নিয়ম ছিল?
অপরাজিত অধিনায়ক। পরাজিত দল। ইডেন-বিপর্যয়ের শেষ দৃশ্যে ধোনি। ছবি: উৎপল সরকার
গত এক বছরে সকলেরই জানা হয়ে গিয়েছে, চার পাশে নানা রকম মৃত্যু এবং দুঃসংবাদের মধ্যে একটা বহুকথিত সভ্যতাও পরলোকগমন করেছে। যার নাম টিম ইন্ডিয়া! কিন্তু সেটা যে এই পর্যায়ে নেমে গিয়েছে যেখানে বিপক্ষ ম্যাচ শুরুর আগেই মানসিক ভাবে তুমুল রাজত্ব বিস্তার করে রাখছে, ভাবাই যায় না। এ দিন প্রেস বক্সে বসে পাক বোর্ডের কর্তা বিদ্রুপাত্মক সুরে বলছিলেন, “ইয়ে সিরিজ তো জরুরত সে ভি জাদা ওয়ান সাইডেড হো গয়া। মালুমই নেহি পড়া, ইন্দো-পাক টেনশন কেয়া চিজ হ্যায়।” এর চেয়েও বড় বিদ্রুপ অবশ্য পাকিস্তান টিম কলকাতায় আসার আগেই করে রেখেছিল। যখন তারা বলে, পয়লা জানুয়ারি গোটা দিন সুন্দরবন বেড়াবে। নিরাপত্তার কারণে সেটা বাতিল হওয়ার পরে টিম আবদার ধরে লঞ্চে করে রায়চক যাবে। নানা কারণে সেটাও সম্ভবপর না হওয়ায় অগত্যা তারা ইডেনে আসে। পাঁচ বছর বাদে অগ্নিগর্ভ একটা সিরিজে এসে এই রকম তাচ্ছিল্য কল্পনারও বাইরে। জিতে উঠেও তো একজন স্টাম্প তুললেন। একজন কোচ হোয়াটমোরকে কাঁধে তুলে নিলেন। ব্যস, উচ্ছ্বাসের শেষ। তাই মিসবাদের ড্রেসিংরুম দেখার এত লোভ হচ্ছিল। কে বলতে পারে সেখানেও পাক পোস্ট অফিসে লগ্নি বা আইপিএলে অংশ নেওয়া যায় কি না আলোচনা চলছিল না!
ইডেনে মহা সমরোহে উদযাপিত হল প্রথম ওয়ানডে ম্যাচের পঁচিশ বছর। সেলিম মালিকের স্মরণীয় করে রাখা সেই ম্যাচ। কিন্তু রজত জয়ন্তীতে প্রথম ওয়ানডে আদৌ ফিরল কি? মনে হল না। সে দিনটা ভারতের হারেও অগৌরব ছিল না। নিশ্চিত হারা ম্যাচ মালিক ছিনিয়ে নিয়েছিলেন ৩৬ বলে অপরাজিত ৭২ করে। তখনকার দিনে ২০০ স্ট্রাইকরেট অলৌকিক সদৃশ। তাতে তবু সান্ত্বনা ছিল। এই যে ভারত হেরে ইডেনের খচাখচ ভরা গ্যালারিকে প্রবল বিরক্তিতে ডুবিয়ে দিল, তাদের সম্পর্কে শেন ওয়ার্নের একটা সংক্ষিপ্ত অভিব্যক্তি আছে।
কান্ট ব্যাট। কান্ট বোল। কান্ট ফিল্ড।
অতীতে মেঘলা পরিবেশে যত বার ভারত-পাকিস্তান দেখা হয়েছে, টুকরো টাকরা খেলা বাদ দিলে ভারতই জিতেছে। এমনকী প্রবল পরাক্রান্ত খান-সভ্যতার সময়েও। পরিবেশ আর পিচ ভারতের অপেক্ষাকৃত দুর্বল বোলিং আক্রমণকে পাক সমতুল্য করে দিয়েছে। ঢেকে দিয়েছে দু’দলের ফারাক। ইডেনও ব্যতিক্রম হবে না এমন ধারণায় কোনও অন্যায় ছিল না। তার ওপর ধোনি টস জিতলেন এমন একটা সময়, যখন টানা হাওয়া দিচ্ছে। হাইকোর্টের দিকে একটা দেশলাই জ্বাললে মোহনবাগান মাঠ থেকে সেটা দেখা যাবে এমন কম আলো। ইদানীং ভারতীয় বোলিংয়ের এক নম্বর সম্ভাবনা ভুবনেশ্বর কুমার যখন আম্পায়ার ‘প্লে’ বলার পর দৌড় শুরু করেছেন, মনে হল আজকের আনন্দবাজারে ইমরানের লেখার হেডিংটা মিলে যাবে ইডেনে সুইং-ই হবে রাজা।
মহম্মদ হাফিজ আর নাসির জামশেদ যে ম্যাচটা এই ভাবে নিয়ে যাবেন কে জানত। তাঁরা যা তুললেন, গোটা ভারত তুলেছে তার চেয়ে মাত্র ২৪ রান বেশি। দিন্দার বলে অশ্বিন একটা ক্যাচ পেয়েছিলেন। তখনকার মতো মনে হয়েছিল দামি। এখন মনে হচ্ছে ওটা ধরলেও কিছু আসত যেত না। নাসির জামশেদ আর তাঁর বোন যমজ। বোন থাকেন আমেরিকায়। তিনি লাহৌরে। অদ্ভুত ব্যাপার হল, দু’টো ভিন্ন গোলার্ধ, দু’টো ভিন্ন টাইম জোন হয়েও একজনের শরীর নাকি আর একজনকে নিয়ন্ত্রণ করে। এর জ্বর হলে ওর জ্বর হয়। ইনি পজিটিভ মানসিকতায় থাকলে আমেরিকায় উনিও ভাল থাকেন। অনুমান করার ব্যর্থ চেষ্টা করছি ওয়ানডেতে ভারতের বিরুদ্ধে এই যে সেঞ্চুরির হ্যাটট্রিক করলেন নাসির, তাতে আমেরিকায় বসা তাঁর বোনের কর্মজীবনেও কি সাফল্য আসছে?
এই পাকিস্তানের খেলা দেখেই বোঝা সম্ভব, কেন তারা ওয়ানডেতে প্রথম সারির দল নয়। পেস বোলিং আক্রমণ যথেষ্ট ভাল। স্পিনে সঈদ আজমল স্বয়ং আছেন। কিন্তু ফিল্ডিংটা যথেষ্ট ভুলভাল। আর ব্যাটিংও মোটেও বিশ্বের প্রথম সারির নয়। মনে রাখতে হবে গত বছর একটাও ওয়ানডে সিরিজ জেতেনি পাকিস্তান। ইডেনে বিনা উইকেটে ১৪১ থেকে বিশ্বপর্যায়ে মিলন সমিতি মার্কা ভারতীয় আক্রমণকেও কিনা তারা দিল দশ উইকেটে মাত্র ১০৯ রান। নিজের দেশের উইকেটে আড়াইশো রান তাড়া করা এখনকার ওয়ানডে ক্রিকেটে কোনও ব্যাপারই না।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখা গেল যথেষ্ট আশাবাদী, “রানটা হয়ে যাবে।” কৃষ্ণমাচারি শ্রীকান্ত যিনি ইডেনে উদ্বোধনী সেই ম্যাচে ঝোড়ো সেঞ্চুরি করেছিলেন, তিনি কলকাতার বন্ধুকে অভয় দিলেন, “ওনলি টু ফিফটি মাচা। ইজি মাচা।”
ভারতের পাঁচ উইকেট পড়ার পরে শ্রীকান্তকে খুঁজতে গেলাম তিন তলার বক্সে। দেখলাম তিনি তো নেই-ই। প্রাক্তনরা কেউ নেই। ভারতীয়দের নীরব সমর্পণ দেখে যে যাঁর মতো হোটেলে ফেরত। এমনিতেই গোটা দিনের রং ছিল ধূসর। চড়া রোদ ওঠেইনি। এ ভাবে সিরিজ খুইয়ে ভারতীয় ক্রিকেটের অলিন্দের রংও ধূসর। নন্দনকাননে কোথায় একটা মারকাটারি যুদ্ধ হবে। অন্তত গল্প বলার মতো পঁচিশ বছর আগের স্মৃতি বিজড়িত একটা ম্যাচ দেখা যাবে। তা নয়। ফিরে এল ষোলো বছর আগের অভিশপ্ত রাত। বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে একপেশে হারের পর এমনই রক্তাক্ত আর বিধ্বস্ত হয়ে ফিরে গিয়েছিল ইডেনবাসী।
এই টিম আমুল বদলাতে হবে বোঝাই যাচ্ছে। সহবাগ-গম্ভীরের মধ্যে একজনকে বসাতে হবে। বোলিং ঠিক করতে হবে। অন্তত ওয়ানডেতে ক্যাপ্টেন বদলানো উচিত কি না সেটা গোটা দিনের রঙের মতোই ধূসর। ধোনিকে চার নম্বরে অবশ্যই তুলে আনা উচিত। কিন্তু নেতৃত্বে তাঁর সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীরা যে কেউ রান করছেন না! ভারতীয় ক্রিকেটের অন্তত তিন জন প্রাক্তন অধিনায়ক এখনই একটা বদলে বিশ্বাসী। মোটেও ফেলনা নয় এঁদের নামগুলো। বিষেণ সিংহ বেদী। অজিত ওয়াড়েকর। গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। তাঁরা কোচ ফ্লেচারের অপসারণই শুধু চান না, ওই পদে দেখতে চান সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে। ক্রিকেট গসিপ হল, সৌরভ আর বোর্ডপ্রধানে নাকি হালকা কথাও হয়েছে। সৌরভ নিজে অবশ্য ধোনিদের শেষকৃত্য দেখতে দেখতে বললেন, “হান্ড্রেড পারসেন্ট বাজে কথা। আমার সঙ্গে মিস্টার শ্রীনিবাসনের কোনও আলোচনা হয়নি। অন্যরা কে কী বলছে তাতে আসে-যায় না।”
কিন্তু কোচের দায়িত্ব পেলে অসুখ সারাতে পারবেন? মৃত টিম ইন্ডিয়ার স্থপতি বললেন, “ঠিক ছ’মাসে সারিয়ে দেব।” হাবেভাবে পরিষ্কার, সাধিলে না খাওয়ার কোনও কারণ নেই।
ইডেনে ছিয়ানব্বইয়ের সেই অভিশপ্ত রাতের মাস তিনেকের মধ্যে বাঙালি ক্রিকেটে তার প্রিয়তম সন্ধে উপহার পেয়েছিল। বাড়ির ড্রয়িং রুমে বসে দেখেছিল সৌরভের লর্ডসে সেঞ্চুরি। বৃহস্পতিবারও তো একটা সেমি-অভিশপ্ত রাত গেল। তা হলে? তার পর?

পাকিস্তান
জামশেদ বো জাডেজা ১০৬
হাফিজ বো জাডেজা ৭৬
আজহার রান আউট ২
ইউনিস এলবিডব্লিউ রায়না ১০
মিসবা এলবিডব্লিউ অশ্বিন ২
শোয়েব ক যুবরাজ বো ইশান্ত ২৪
কামরান ক সহবাগ বো জাডেজা ০
গুল বো ইশান্ত ১৭
আজমল ক সহবাগ বো ভুবনেশ্বর ৭
জুনায়েদ ন.আ. ০
ইরফান বো ইশান্ত ০
অতিরিক্ত:
মোট (৪৮.৩ ওভারে) ২৫০
পতন: ১৪১, ১৪৫, ১৭৭, ১৮২, ২১০, ২১০, ২৩৬, ২৪৯, ২৫০,২৫০
বোলিং: ভুবনেশ্বর ৯-০-৬১-১, দিন্দা ৭-০-৪২-০, ইশান্ত ৯.৩-০-৩৪-৩,
অশ্বিন ১০-০-৪৯-১, রায়না ২-০১৩-১, জাডেজা ১০-১-৪১-৩, যুবরাজ ১-০-১০-০

ভারত
গম্ভীর বো জুনায়েদ ১
সহবাগ এলবিডব্লিউ গুল ৩১
কোহলি ক কামরান বো জুনায়েদ ৬
যুবরাজ ক কামরান বো গুল ৯
রায়না বো হাফিজ ১৮
ধোনি ন. আ. ৫৪
অশ্বিন বো শোয়েব ৩
জাডেজা ক জুনায়েদ বো আজমল ১৩
ভুবনেশ্বর এলবিডব্লিউ আজমল ০
দিন্দা এলবিডব্লিউ আজমল ২
ইশান্ত বো জুনায়েদ ২
অতিরিক্ত: ১৮
মোট (৪৮ ওভার) ১৬৫
পতন: ৪২, ৫৫, ৫৯, ৭০, ৯৫, ১০৩, ১৩১, ১৩১, ১৩২, ১৬৫
বোলিং: ইরফান ১০-০-৪৬-০, জুনায়েদ ৯-১-৩৯-৩, গুল ৭-০-২৪-২,
হাফিজ ১০-০-২৯-১, আজমল ১০-১-২০-৩, শোয়েব ২-১-৩-১




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.