প্লেগে উজাড় হয়ে যাচ্ছে কলকাতা। রাস্তায় নেমে পড়েছেন নিবেদিতা। স্বামী বিবেকানন্দ প্রস্তাব দিলেন, আর্ত মানুষের সেবায় টাকা জোগাড়ে বিক্রি করে দেওয়া হোক বেলুড়ে মঠ তৈরির জন্য কেনা ২২ বিঘা জমি। বিবেকানন্দ-শিষ্যা হেনরিয়েটা মুলার প্রদত্ত ৩৯ হাজার টাকায় প্রথমে কেনা হয়েছিল ওই পরিমাণ জমি। বাধা দিলেন শ্রীমা সারদামণি। স্বামীজিকে ডেকে জানিয়ে দিলেন, এই জমি শ্রীরামকৃষ্ণকে ও তাঁকে (সারদাকে) উৎসর্গীকৃত। অতএব, এ জমি কোনও ভাবেই বিক্রি করা যাবে না। বেলুড় মঠ কি একটি সেবাকাজেই নিঃশেষিত হয়ে যাবে? মায়ের আদেশ নতমস্তকে মেনে নিলেন স্বামীজি।
শ্রীমাকে মমতাময়ী কল্যাণরূপিণী মূর্তিতেই দেখতে অভ্যস্ত আমরা। কিন্তু প্রয়োজনে তিনি বজ্রকঠিন রূপও ধারণ করেছেন। সঙ্ঘজননী হিসাবে টানা ৩৪টি বছর (১৮৩৬-১৯২০) সুদক্ষ হাতে মোকাবিলা করেছেন হাজারো প্রতিকূল পরিস্থিতির। কোনও বিষয়ে সঙ্ঘে মতপার্থক্য দেখা দিলে মায়ের হাত ধরেই ঘটেছে তার সমাধান। স্বামী বিবেকানন্দ-সহ সকল সন্ন্যাসীই বারবার সকৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করেছেন সে কথা। অথচ বাইরের জগতে মায়ের এই প্রশাসক সত্তার কথা খুব কমই আলোচনায় এসেছে।
কয়েকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করা যাক। |
আজ শ্রীশ্রীমা সারদার ১৬১তম জন্মতিথি |
সাক্ষাৎ শিবজ্ঞানে জীবসেবার প্রায়োগিক লক্ষ্যে স্বামীজি বিবেকানন্দের নির্দেশে বারাণসীতে রামকৃষ্ণ মিশন হোম অব সার্ভিস কেন্দ্রটি (১৯০২) প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে নির্মিত পূর্ণাঙ্গ হাসপাতালকে কেন্দ্র করে সন্ন্যাসী ও গৃহী পার্ষদদের মধ্যে প্রবল মতানৈক্য দেখা দিল। দরিদ্র-স্পৃশ্য-অস্পৃশ্য নানা রোগীর বিবিধ সেবা, মলমূত্রাদি পরিষ্কার এ সবকে রামকৃষ্ণ-অর্পিত ‘কাজ’ বলে অনেকেই মানতে চাইছিলেন না। খবর গেল মায়ের কাছে। মা একটি চিঠি (আদেশনামা) লিখে জানালেন যে, নরেন (বিবেকানন্দ) নির্দেশিত পথেই সন্ন্যাসীরা হাসপাতালের সেবাকাজ চালাবেন।
মায়াবতী আশ্রম (১৮৯৯) তুষার-পরিবৃত হিমালয়ের বুকে প্রকৃতির মনোরম আবহে অদ্বৈত ভাবে সাধনার জন্য আদর্শ। স্বামীজি সেখানে নিরাকার ব্রহ্মের সাধনার কথা বলেছিলেন। অর্থাৎ কোনও পট বা মূর্তি থাকবে না। রামকৃষ্ণ শিষ্য-পার্ষদদের অনেকেই এ নিয়ে তীব্র অসন্তোষ প্রকাশ করেন। শ্রীমা সারদাকে বিচারের ভার দিলেন সকলে। প্রশাসক সারদা তত্ত্বজ্ঞান ও রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের দার্শনিক ভিত্তিকে আশ্রয় করে নিরাকার ব্রহ্মসাধনার নির্দেশই বহাল রাখলেন। আজও মায়াবতীতে সেই রীতি অনুসৃত হয়ে আসছে।
চুরির অপরাধে স্বামীজি বরখাস্ত করেছিলেন বেলুড় মঠের বেতনভুক এক ওড়িয়া কর্মচারীকে। সে গঙ্গা পেরিয়ে সোজা হাজির বাগবাজারে। ‘উদ্বোধন’-এ পৌঁছে দোষ স্বীকার করে সে পায়ে পড়ল শ্রীমায়ের। সব শুনে মা স্বামী প্রেমানন্দকে নির্দেশ দিলেন তাকে মঠে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। প্রেমানন্দজির সঙ্গে কর্মচারীটিকে মঠে ফিরতে দেখে রেগে আগুন হন স্বামীজি। পরে অবশ্য সব শুনে হাসতে হাসতে বলেন, ‘ব্যাটা, হাইকোর্ট চিনে গেছিস!’ অর্থাৎ মা’র পরে আর কোনও কথা চলে না।
কোনও ব্রহ্মচারী কিংবা সন্ন্যাসী যদি রামকৃষ্ণ মঠ-মিশনের আদর্শবিরোধী কাজ করেন, মা তাঁকে মঠের সংস্রব ত্যাগের নির্দেশ দিয়েছেন। কোমল হৃদয়ে তাঁকে এগিয়ে দিয়েছেন ফিরে যাওয়ার পথে। কিন্তু অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। সন্ন্যাসীর আচরণ সম্পর্কে তাঁর নির্দেশ‘সাধু সব মায়া কাটাবে। সোনার শিকলও বন্ধন, লোহার শিকলও বন্ধন। মায়ার শৃঙ্খলে জড়াতে নেই।’ শ্রীমা-শিষ্য স্বামী শান্তানন্দ একবার শ্রীরামকৃষ্ণের কয়েকজন গৃহী ভক্তের সঙ্গে কাশীযাত্রায় উদ্যোগী হলে মা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, গৃহস্থের সঙ্গে সন্ন্যাসীর একত্র তীর্থযাত্রা সমীচীন নয়। মার যুক্তি শুনে শান্তানন্দজি যাত্রা স্থগিত রাখেন।
ব্রিটিশ গোয়েন্দাপ্রধান চার্লস অগস্টাস টেগার্ট-এর রিপোর্টের (১৯১৪) ভিত্তিতে বাংলার গভর্নর লর্ড কারমাইকেল বিপ্লবীদের সাহায্য করা এবং আশ্রয় প্রদানের অভিযোগে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয় বেলুড় মঠকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার জন্য ১৯১৬-র ১১ ডিসেম্বর বিশেষ বৈঠক ডেকেছিলেন। সে-খবর পেয়েই শ্রীমা চটজলদি মঠের তৎকালীন সম্পাদক সারদানন্দ এবং জোসেফিন ম্যাকলাউডকে পাঠালেন কারমাইকেলের কাছে। মা বুঝিয়ে বলতে বলেন যে, বেলুড় মঠকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলে তা ব্রিটিশ সরকারেরই বিড়ম্বনা বাড়াবে। শেষ পর্যন্ত কারমাইকেলের হস্তক্ষেপে ব্রিটিশ সরকার বেলুড় মঠকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা থেকে বিরত হয়। ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের বিশেষ নজর ছিল বেলুড় মঠ, উদ্বোধন, জয়রামবাটী, কোয়ালপাড়া ইত্যাদি স্থানের উপরে। সেই সময়ে অনেক বিপ্লবী মায়ের অনুমতি নিয়েই আশ্রয় নিয়েছিলেন। তরুণ বিপ্লবীদের জন্য তাঁর ভালবাসার অভাব ছিল না।
স্বামী প্রেমানন্দ একটি চিঠিতে লিখেছেন, ‘শ্রীমার আদেশ পালনই আমাদের ধর্ম, কর্ম। আমরা যন্ত্র, তিনি যন্ত্রী। যাকে যা বলবেন, সে তাই করতে বাধ্য।’ প্রেমানন্দের শ্রীমা সারদা সম্পর্কিত অভিমত এই যে, রাজরাজেশ্বরী মা শাক বুনে খাচ্ছেন, ভক্তের এঁটো কুড়োচ্ছেন, কাঙালিনী সেজে ছেঁড়া কাপড় তালি দিয়ে পরছেন। রামকৃষ্ণ সঙ্ঘের সর্বোচ্চ স্থানে আসীন থেকেও কখনও কোথাও কোনও অধিকার কায়েম করতে চাননি তিনি। নেননি কোনও বাড়তি সুযোগ-সুবিধা। সুদক্ষ প্রশাসক হিসাবেও ইতিহাসে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে গিয়েছেন তিনি। |