গুজরাতের লোকায়ুক্ত পদে আর এ মেটার নিয়োগে সিলমোহর লাগাইয়া সুপ্রিম কোর্ট মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে নিশ্চিত রূপেই বিপাকে ফেলিয়াছেন। কারণ শ্রীমেটা মোদীর ‘অপছন্দের ব্যক্তি’ ছিলেন এবং তাঁহার মনোনয়ন লইয়া মুখ্যমন্ত্রী মোদীর তীব্র আপত্তিও ছিল। পাশাপাশি তাঁহার প্রার্থিপদ সমর্থন করিয়া রাজ্যপাল কমলা বেনিয়াল মুখ্যমন্ত্রী মোদীর সহিত রীতিমত সংঘাত ও দ্বন্দ্বের পরিস্থিতি সৃষ্টি করেন। মেটার নির্বাচনে শীর্ষ আদালতের সবুজ সংকেত তাই আপাতবিচারে মুখ্যমন্ত্রীর হেনস্থা এবং রাজ্যপালের বিজয় রূপে প্রতিভাত হইতে পারে। কিন্তু বাস্তবে বিষয়টি এত সহজ ও একমাত্রিক নয়। সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতির বেঞ্চ মুখ্যমন্ত্রী মোদীর আপত্তি অগ্রাহ্য করার পাশাপাশি রাজ্যপালের সাংবিধানিক এক্তিয়ারও নির্দিষ্ট করিয়া দিয়া বলিয়াছেন রাজ্যপাল লোকায়ুক্ত নিয়োগে একতরফা সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকারী নহেন, তাঁহাকে রাজ্যের নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁহার মন্ত্রিসভার পরামর্শ অনুযায়ীই কাজ করিতে হইবে।
রাষ্ট্রপতি এবং রাজ্যপাল পদ দুইটির সাংবিধানিক এক্তিয়ারের সীমানা নির্দিষ্ট করার কাজটি বারংবার আদালতকে করিতে হয়। তাঁহারা যে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে নির্বাচিত আইনসভা হইতে গঠিত মন্ত্রিসভা কর্তৃক পরিচালিত হইবেন, ইহা বারংবার তাঁহাদের স্মরণ করাইতে হয়। গুজরাতের লোকায়ুক্ত পদে যে তথাপি রাজ্যপাল মনোনীত প্রার্থীকেই শীর্ষ আদালত স্বীকৃতি দিল, তাহার কারণ, ওই প্রার্থী পূর্বেই গুজরাত হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি দ্বারাও মনোনীত হন। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদ্বয় হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতির পছন্দের বিচারককেই নিয়োগপত্র দিতে নির্দেশ দিতেছেন। মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পছন্দের ব্যক্তিকে লোকায়ুক্ত নিয়োগের প্রশ্নে আপত্তির সম্ভাব্য কারণ হয়তো সেই ব্যক্তির মোদীর হইয়া কাজ করার আশঙ্কা। মোদী কিন্তু নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে রাজ্যের আইন ও শাসন বিভাগের প্রধান। আদালতের প্রতি সম্পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখিয়াই বিনীত ভাবে এই প্রশ্ন তোলা যায় যে, মুখ্যমন্ত্রীর ‘পছন্দের ব্যক্তি’ বিচারবিভাগীয় উচ্চ পদে নিযুক্ত হওয়ায় যদি সাংবিধানিক নৈতিকতার আদর্শ লঙ্ঘিত হয়, তবে বিচারপতিদের পছন্দের আইনজীবীর অনুরূপ পদে নিয়োগও কি বিধেয়? বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে বিচারবিভাগের ভূমিকা কেন প্রধান হইবে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে কিন্তু শাসনবিভাগের প্রধানরাই বিচারপতিদেরও নিয়োগ করিয়া থাকেন। তাঁহারা নিয়োগের পূর্বে যদি বা নির্দিষ্ট কোনও রাজনীতিকের ‘কাছের লোক’ বলিয়া গণ্য হন, নিযুক্ত হওয়ার পর তাঁহাদের ক্রিয়াকলাপে পদের সমুচ্চ মর্যাদা হেয় করার নজির বিরল। ভারতীয় সমাজ হয়তো এখনও এতটা নৈতিক আদর্শবাদ আয়ত্ত করিতে পারে নাই। তাই এখানে বিচারপতিদের নিয়োগের ক্ষেত্রেও ‘কলেজিয়াম’ রাখার প্রস্তাবটি আলোচিত হয়।
আলোচিত হইলেও প্রস্তাবটি এখনও কার্যকর হয় নাই। এই ধরনের কলেজিয়াম যথার্থ গণতন্ত্রসম্মত হওয়া উচিত। যেমন, সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি নিয়োগের কমিটিতে প্রধানমন্ত্রীর মতো আইনসভার বিরোধী নেতারও থাকা বাঞ্ছনীয়। রাজ্যে রাজ্যে হাইকোর্টগুলির বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রেও এমন ব্যবস্থা থাকা শ্রেয়। লোকায়ুক্ত পদটি যদি রাখিতেই হয়, তবে তাহার ক্ষেত্রেও একই ধরনের পদ্ধতি অনুসৃত হওয়া উচিত, কারণ ইহাও কার্যত একটি বিচারবিভাগীয় পদ। পরিষদীয় গণতন্ত্রে এ ধরনের পারস্পরিক নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি মারফতই বিভিন্ন সাংবিধানিক, প্রশাসনিক ও শাসনপ্রণালীগত কর্তৃপক্ষের মধ্যে সুষম ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। বিচারপতিরাই কেবল বিচারবিভাগ সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে শেষ কথা বলিবেন, ইহা অভিপ্রেত নয়। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের, আইনসভার, শাসক ও বিরোধী দলের সদস্যদেরও এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক পরামর্শ দিবার সুযোগ থাকা উচিত। মনে রাখা দরকার, গণতন্ত্রে, বিশেষত প্রতিনিধিত্বমূলক পরিষদীয় গণতন্ত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসভাই প্রাথমিক ও সার্বভৌম, আর সব কিছুই, সকলেই গৌণ। |