|
|
|
|
সাক্ষ্য দেওয়ার প্রস্তুতি |
যন্ত্রণা নিয়েই বান্ধবীর আশা পূরণের যুদ্ধ শুরু তরুণের
প্রেমাংশু চৌধুরী • নয়াদিল্লি |
মাথায়, হাতে-পায়ে এখনও ব্যান্ডেজ। ডান পায়ে ছ’টা সেলাই। চোখের তলায় কালসিটে। সারা শরীরে লোহার রডের আঘাত। কিন্তু শরীরের এই যন্ত্রণা এখন আর তাঁকে ততটা কষ্ট দেয় না। সেই যন্ত্রণা ছাপিয়ে গিয়েছে হাজার গুণ গভীর মানসিক আঘাত।
না কি দুঃস্বপ্ন? ২৮ বছরের যুবক এখনও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পান রাতের বাসে তাঁর চোখের সামনে বান্ধবীর উপর গণধর্ষণ, নৃশংস মারধর ও যৌন অত্যাচার। দিল্লিতে বসেই তাঁকে শুনতে হয়েছে সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে বান্ধবীর মৃত্যুসংবাদ। এই দুঃসহ অভিজ্ঞতার বোঝা তো তাঁকে সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে।
তবু তার মধ্যেই দোষীদের শাস্তি দেওয়ার লড়াই শুরু করছেন ২৮ বছরের সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার যুবকটি। ইতিমধ্যেই ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হয়ে তিন ঘণ্টা ধরে জবানবন্দি রেকর্ড করিয়েছেন। পুলিশের সামনে ধর্ষণে অভিযুক্তদের শনাক্ত করেছেন। আজই দক্ষিণ দিল্লির সাকেত জেলা আদালতে গণধর্ষণ মামলার চার্জশিট পেশ করেছে পুলিশ। যে মামলায় ওই যুবকই প্রধান অভিযোগকারী। এবং তিনিই প্রধান সাক্ষী। মামলার শুনানি শুরু হলে যখনই প্রয়োজন পড়বে তখনই আদালতে হাজির হবেন বলে পরিবারের লোকজনকে জানিয়েও দিয়েছেন তিনি। তাঁর মামা, পেশায় আইনজীবী ডি কে মিশ্রর বক্তব্য, “শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা নিয়েই এত দিন ও পুলিশের সঙ্গে সহযোগিতা করেছে। এ বার বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলেও এগিয়ে আসবে ও। পিছিয়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্নই নেই।” |
প্রতিবাদ। সাকেত আদালতের বাইরে। বৃহস্পতিবার। ছবি: এ এফ পি |
দিব্যি ছিলেন। কিন্তু গত ১৬ ডিসেম্বর রাতের ঘটনাটা জীবনটাই বদলে দিয়েছে গোরক্ষপুরের যুবকটির। বান্ধবীর সঙ্গে ‘লাইফ অফ পাই’ দেখে রাতে মুনিরকা থেকে বাসে উঠেছিলেন দু’জনে। বুঝতেও পারেননি, বাসের মধ্যে যাত্রীর ভেক ধরে আসলে ছয় মদ্যপ ওত পেতে রয়েছে। বাসের ওঠার পরেই বচসা। এবং তার পর ওই যুবকের সামনেই তরুণীর উপর গণধর্ষণ চালায় ছ’জন। বাধা দিতে গেলে প্রচণ্ড মারধর করা হয় দু’জনকেই। জামাকাপড়ও ছিঁড়ে দেওয়া হয়। তার পরে দু’জনকেই বাস থেকে ফেলে দিয়ে চাকার তলায় পিষে ফেলার চেষ্টা হয়। রক্তাক্ত বান্ধবীকে কোনও রকমে টেনে তখনকার মতো প্রাণে বাঁচালেন। বাকিটুকু সকলেরই জানা। যুবক কিন্তু থেমে ছিলেন না। পুলিশের কাছে এফআইআর করতে গিয়ে গোটা ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন। সে দিন রাতে মুনিরকা থেকে বাসে ওঠার পরে প্রথমে তাঁরা কোথায় বসেছিলেন, কারা কারা ধর্ষণ করেন, ধর্ষণের পরেও কী ভাবে যৌন অত্যাচার চালানো হয়, বাধা দিতে গেলে কী ভাবে মারধর করা হয়, সবই এফআইআরে আছে। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেও বিস্তারিত জানিয়েছেন তিনি।
ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করার পর দিল্লিতে এসে চার বছর ধরে সিভিল সার্ভিস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন ওই যুবক। তাঁর পরিবারের লোকেরা বলছেন, ওই ঘটনার পর থেকেই ছটফটে, প্রাণবন্ত ছেলেটি একেবারে চুপচাপ, শান্ত হয়ে গিয়েছেন। বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কথাবার্তা বলছেন না। যে ক’দিন তরুণীর চিকিৎসা চলেছে, দিল্লির পথে নেমেছে জনতা, উত্তাল হয়েছে গোটা দেশ, তিনি শুধু খবরের চ্যানেল দেখেছেন। বাড়ির লোকেরা জানাচ্ছেন, সিঙ্গাপুরের হাসপাতালে বান্ধবীর মৃত্যুর খবরও টিভি দেখেই জানতে পারেন যুবক। পরে খবরটা পেয়েও বাড়ির লোকের সাহসই হয়নি এ নিয়ে তাঁর সঙ্গে কথা বলার। ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে জবানবন্দি দেওয়ার পরে ওই যুবকের বাবা দিল্লি এসেছিলেন ছেলেকে গোরক্ষপুরে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যেতে। কিন্তু সেখানে গিয়েও মানসিক অবস্থার কোনও হেরফের হয়নি ওই যুবকের।
১৬ ডিসেম্বর রাতের ওই ঘটনার পরে কি দু’জনের আর দেখা হয়েছিল? পরিবারের লোকেরা জানাচ্ছেন, সফদরজঙ্গ হাসপাতালে চিকিৎসা চলাকালীন বান্ধবীকে দেখতে গিয়েছিলেন ওই যুবক। দু’জনের মধ্যে সে দিন কথাও হয়। তখনই যুবক তরুণীকে জানান, ছয় অভিযুক্তই পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। তাঁদের কড়া শাস্তির জন্য দেশ জুড়ে দাবি উঠেছে। প্রবল শারীরিক যন্ত্রণার মধ্যেও এই খবরে আশার আলো ফুটে উঠেছিল ২৩ বছরের তরুণীটির মুখে। অপরাধীদের কঠোর শাস্তিই তো চেয়েছিলেন তিনিও।
বান্ধবীর সেই আশা পূরণ করতেই সাক্ষ্য দেওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেছেন ওই যুবক। শুধু দোষীদের শাস্তি নয়, ধর্ষণ-বিরোধী আইন কঠোর করার প্রক্রিয়াও এই মামলার সঙ্গে জুড়ে দিতে চাইছেন তিনি। যুবকের বাবা ও মামা, দু’জনেই পেশায় আইনজীবী। যুবকের মামা জানান, ছয় অভিযুক্তের মধ্যে এক জন নিজেকে নাবালক বলে দাবি করলেও তারও যাতে একই সঙ্গে বিচার হয়, সে দাবিও জানাবেন তাঁরা। তাঁর যুক্তি, বয়স প্রমাণ করার শারীরিক পরীক্ষা করতে হবে। এ-ও মনে রাখতে হবে, ওই অভিযুক্তও কিন্তু তরুণীকে ধর্ষণ, অত্যাচারের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। আইন সংশোধনের জন্য এই মামলায় আইন মন্ত্রককেও যাতে অংশীদার করা হয়, সে দাবিও জানাবেন তিনি। ডি কে মিশ্রের মতে, অভিযুক্তরা দোষ স্বীকার করলে ১৫ দিনেই মামলার নিষ্পত্তি হতে পারে। না হলে দু’তিন মাস লাগবে। |
|
|
|
|
|