তৃণমূল প্রভাবিত দুই বাসকর্মী সংগঠনের মারপিটে আগের দিনই বাস চলাচল বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আসানসোলে। নিরাপত্তার অভাবের কথা তুলে বৃহস্পতিবার চিত্তরঞ্জনে বাস বন্ধ করে দিল সিটু।
গোষ্ঠী সংঘর্ষ হোক বা দাবি-দাওয়া, নানা ছুতোয় আচমকা বাস বন্ধ করে দেওয়া কার্যত অভ্যেসে পরিণত হয়েছে আসানসোল শিল্পাঞ্চলে। বিপাকে পড়ছেন রাস্তায় বের হওয়া মানুষজন। প্রশাসন উদ্বিগ্ন। কিন্তু রাজনীতির খেলা চলছেই।
গত ১ জানুয়ারি তৃণমূলের প্রতিষ্ঠা দিবসে একটি বাস থেকে দলীয় পতাকা খুলে ফেলার জেরে বুধবার আসানসোল সিটি বাসস্ট্যান্ডে মিনিবাস বন্ধ করিয়ে দিয়েছিল আইএনটিটিইউসি। বড় বাসও বন্ধ করার চেষ্টা হয়। কিন্তু আইএনটিটিইউসি-রই সংগঠন রুখে দাঁড়ানোয় দু’পক্ষে মারপিট বেধে গিয়েছিল। ঘণ্টা চারেক বাস চলাচল বন্ধও থাকে। এ দিন সেখানে আর নতুন করে অশান্তি হয়নি। কিন্তু পতাকা খোলার ঘটনায় আইএনটিটিইউসি-র লোকজন তাদের সমর্থকদের হুমকি দিচ্ছে বলে সিটুর অভিযোগ। সংগঠনের চিত্তরঞ্জন শাখার সম্পাদক সুকান্ত দাস বলেন, “নিরাপত্তার অভাব বোধ করায় আমাদের প্রভাবিত প্রায় ৬০টি বড় বাস ও মিনিবাস চলাচল বন্ধ রেখেছি। নিরাপত্তার আশ্বাস না পাওয়া পর্যন্ত বাস বন্ধই থাকবে।” |
পান থেকে চুন খসলেই ফিরে আসে এই ছবি। —নিজস্ব চিত্র। |
সিটুর তরফে জানানো হয়েছে, আসানসোল থেকে যাত্রিবাহী বাস শহরে ঢুকতে বাধা দেওয়া হচ্ছে না। তবে চিত্তরঞ্জন থেকে কোনও বাস যেতেও দেওয়া হচ্ছে না। আইএনটিটিইউসি অবশ্য সিটুর লোকজনকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ অস্বীকার করেছে। সংগঠনের বাস কর্মী ইউনিয়নের সম্পাদক রাজু অহলুওয়ালিয়ার দাবি, “আমরা কোনও সিটু কর্মীকে হুমকি দিয়নি। পতাকা খুলে নেওয়ার ঘটনায় জড়িত সিটুর সদস্যদের খুঁজে বের করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়েছি পুলিশের কাছে।” পুলিশ জানিয়েছে, নির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আসানসোলের মহকুমাশাসক শিল্পা গৌরীর বক্তব্য, বাস বন্ধের কারণ খতিয়ে দেখতে বিস্তারিত খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দাদের বড় অংশেরই অভিযোগ, বাম সরকারের আমলে যেমন নিজেদের মর্জিমাফিক যখন-তখন বাস বন্ধ করে দিত সিটু, বর্তমান শাসকদল তৃণমূলের প্রভাবিত শ্রমিক সংগঠনও একই রকম আচরণ করছে। সিটু-ও পুরনো অভ্যেস ছাড়তে পারেনি। আসানসোল মিনিবাস অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক সুদীপ রায়ের আক্ষেপ, শ্রমিক সংগঠনের নেতারা তাঁদের সঙ্গে আগাম আলোচনা না করেই একতরফা বাস বন্ধের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। ফলে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছেন তাঁরা। সুদীপবাবু বলেন, “বাসগুলি আমাদের না শ্রমিক সংগঠনের, সেটাই আমরা ভুলে যাচ্ছি। গাঁটের কড়ি খরচ করে আমরা রাস্তায় বাস নামাই। অথচ বাস চালানোর ব্যাপারে আমাদেরই মতামতের ভূমিকা নেই। আমরা রীতিমতো আতঙ্কিত।”
ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষও। আসানসোল আদালতের সরকারি আইনজীবী স্বরাজ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, দাবি-দাওয়া বা অভিযোগ ন্যায্য বা অন্যায্য যা-ই হোক, শ্রমিক সংগঠনগুলির তা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেই মেটানো উচিত। দুমদাম বাস বন্ধ করে নয়। দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্রী ঋদ্ধিতা মাজির কথায়, “একা একা বাড়ি থেকে বাসে চেপে স্কুলে যাই। কিন্তু মাঝে-মাঝেই এই রকম হচ্ছে। খুব অসহায় লাগে।” অথচ তৃণমূলের রাজ্য নেতারাও বলছেন, শ্রমিক সংগঠনের এই আচরণ মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা বন্ধ-অবরোধের রাজনীতির বিরুদ্ধে। এ দিন কৃষিমন্ত্রী তথা আইএনটিটিইউসি নেতা মলয় ঘটকও বলেন, “সাধারণ মানুষ বিপদে পড়তে পারেন, এ রকম কোনও আচরণই আমাদের সরকার অনুমোদন করে না।”
কিছু নেতা অবশ্য এর পরেও মানতে রাজি নন যে এই আচরণ দায়িত্বজ্ঞানহীনতার নামান্তর। সিটু নেতা সুকান্তবাবু যেমন বলেন, “এ দায় আমাদের নয়। প্রশাসন নিরাপত্তার দায়িত্ব নিলে তবেই আমরা বাস চালাব।” মহকুমাশাসক শিল্পা গৌরী কিন্তু বলছেন, “প্রশাসনিক স্তরে বিষয়টি নিয়ে আমরা আলোচনা শুরু করছি। যে পক্ষেরই অভিযোগ থাক, আমাদের সঙ্গে আলোচনা করলেই তো মিটে যায়।” মলয়বাবুও বলেন, “যে কোনও সমস্যা আলোচনা করে মিটিয়ে নেওয়াই ভাল। বাস বন্ধ হলে সাধারণ মানুষের ক্ষতি।” আসানসোলের তৃণমূল মেয়র তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্বাস, “বন্ধ-অবরোধের মতো রাজনৈতিক বদভ্যাস বদলানোর জন্য দলে কথা বলব।” |