অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী দেবলীনা। বয়সের তুলনায় ওজন অতিরিক্ত বেশি। বন্ধুরা ‘মোটা’ বলে খেপায়। মন নেই পড়াশোনাতেও।
বিট্টুর বয়স মাত্র ১৬ বছর। কয়েক দিন ধরেই পেটে অসহ্য ব্যথা আর জ্বর। ডাক্তারবাবু বলেছেন, বাইরের খাবার একদম বন্ধ রাখতে। অথচ ঘরে তৈরি খাবার তার মুখে রোচে না।
ও দিকে, পিঙ্কির ইচ্ছে করলেও বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে পারে না। ওজন এতই বেড়ে গিয়েছে যে, খেলতে গেলেই কষ্ট হয় ওর। মা শ্রীমতিদেবী জানান, গত দু’বছর আগেও ওর ওজন ঠিকঠাক ছিল।
তবে এই চিম্তা শুধু ওঁদের নয়, কলকাতার মতো সবক’টি মহানগরের ছেলেমেয়েদের একই হাল। মূল কারণ, খেলাধুলোর অবকাশ কমে যাওয়া। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, বেশিরভাগ শিশুই এখন স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে বসে যায় কম্পিউটার গেমস্ নিয়ে। তাদের পছন্দের খাবার বলতেও পিৎজা, বার্গারের মতো সব ফাস্টফুড। আর সন্ধ্যা হলেই নিয়ম মেনে বই নিয়ে বসে পড়া। বিশেষজ্ঞদের মতে, শরীরচর্চার অভাব এবং বেশি ক্যালোরির খাবারই শহরের বাচ্চাদের মধ্যে স্থূলতার প্রবণতা বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সর্বভারতীয় এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে, শহুরে ছেলেমেয়েদের প্রতি দু’জনের মধ্যে এক জন শারীরিক দিক থেকে অপটু। আঠেরোটি রাজ্যের প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্রছাত্রীকে (সাত থেকে সতেরো বছর বয়সের মধ্যে) নিয়ে করা এই সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, প্রতি চার জনের মধ্যে এক জনের বয়সের তুলনায় ওজন বেশি। আটটি মহানগর (দিল্লি, চেন্নাই, বেঙ্গালুরু, হায়দরাবাদ, চণ্ডীগড়, কলকাতা, পুণে, আমদাবাদ) এবং ৪৬টি ছোট শহরের মধ্যে সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, মহানগরে বসবাস করা শিশুদের মধ্যে তুলনামূলক ভাবে ওজন বাড়ার সমস্যা অনেক বেশি। বয়সের সঙ্গে কমতে থাকে শারীরিক ক্ষমতা এবং বাড়তে থাকে ওজন।
|
এই সমস্যা সবচেয়ে বেশি বাড়ে দশ থেকে তেরো বছরের মধ্যে। এন্ডোক্রিনোলজিস্ট শুভঙ্কর চৌধুরী বলেন, “শিশুদের বয়ঃসন্ধিক্ষণে হরমোনগত পরিবর্তনই এর কারণ।” শিশু চিকিৎসক অপূর্ব ঘোষ বলেন, “স্থূলতার কারণবশত ভবিষ্যতে ছেলেমেয়েরা ডায়াবিটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হার্টের সমস্যা, অ্যাপেন্ডিসাইটিস, ক্যানসার, গলস্টোনের মতো সমস্যায় পড়তে পারে। এমনকী, ভবিষ্যতে মানসিক অবসাদগ্রস্তও হতে পারে বলে জানান তিনি। শারীরবিদ্যার অধ্যাপক সুব্রত ঘোষ জানান, ২০-২১ বছর বয়সের মেয়েদের উপরে এর প্রভাব অনেক বেশি। প্রেসিডেন্সির নিজস্ব অভ্যন্তরীণ গবেষণায় জানা গিয়েছে যে, শৈশবের স্থূলতার কারণে এই বয়সের ৮৯% মেয়েরাই হাইপোথাইরয়েডিজম ও পলিসিস্টিক ওভারি নিয়ে সমস্যায় ভুগছে।
বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পিত পরিকাঠামোর অভাব শারীরিক দুর্বলতার কারণ।
কিন্তু সমীক্ষায় এটা স্পষ্ট, ছেলেমেয়েদের শারীরিক অক্ষমতায় বিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট পরিকাঠামোর অভাব কোনও ভাবেই দায়ী নয়। বরং ছোট শহর বা গ্রামের ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে সুনির্দিষ্ট পরিকাঠামো না পেয়ে থাকলেও মহানগরের ছাত্রদের তুলনায় খেলাধুলায় অনেক ভাল ফল করে বলে জানিয়েছে সমীক্ষা। জাঙ্ক ফুড, বাড়িতেই বিনোদনের (ইন্টারনেট, কম্পিউটার, টেলিভিশন) সুবিধা এবং শরীরচর্চার জন্য প্রয়োজনীয় পার্ক না-থাকাই ছেলেমেয়েদের ওজন বাড়ার অন্যতম কারণ।
তাই নতুন প্রজন্মের মধ্যে শারীরিক ক্ষমতা কমার জন্য আধুনিক জীবনযাত্রাকেই দায়ী করছে এই সমীক্ষা। অপূর্ববাবু জানান, বেশি খাওয়া ও কম ক্যালোরি খরচই ওজন বাড়ার কারণ। সপ্তাহে দু’-চার দিন শরীরচর্চা করলে এই সমস্যা অনেকটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়। তাঁর মতে, বাচ্চাদের মোটা হওয়ার প্রবণতা বেড়েই চলেছে। এটা খুবই চিন্তার বিষয়। এ বিষয়ে সচেতন হওয়া খুব প্রয়োজন। |