আগে স্মারকলিপি দিয়েছেন। দেখিয়েছেন বিক্ষোভ। এ বার লাগাতার অনশন শুরু করলেন বাঁকুড়ার ছাতনার গৌরীপুর কুষ্ঠ হাসপাতালের শতাধিক রোগী।
ওই হাসপাতালের চিকিৎসক বাণীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বদলি রদের দাবিতে সোমবার সকাল থেকে হাসপাতাল চত্বরেই অনশন মঞ্চ গড়ে রোগীরা আন্দোলন শুরু করেছেন। তাঁদের কথায়, “উনি আমাদের শরীরের ঘা নিজের হাতে পরিষ্কার করেন। আমাদের কাছে ওই ডাক্তারবাবু তাই পরম আত্মীয়ের চেয়েও বেশি। ওঁকে যেতে দেব না।”
স্বাস্থ্য দফতর এবং আন্দোলনকারীদের মধ্যে অবশ্য এই বদলির সিদ্ধান্তকে ঘিরে অভূতপূর্ব চাপানউতোর শুরু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী এ দিন বলেন, “এই অনশনের চরিত্র একটু আলাদা। এর সঙ্গে চিকিৎসকের ভাল পরিষেবার কোনও সম্পর্ক নেই। উল্টে পুরোটাই ওই চিকিৎসকের করানো!” তাঁর আরও দাবি, “১৩ বছর ধরে ওই চিকিৎসক ওই হাসপাতালে রয়েছেন। তিনি ওই জেলারই লোক। ফলে অতীতে যখনই তাঁকে বদলির কথা উঠেছে, তিনি কোনও না কোনও কায়দায় তা এড়িয়েছেন। এটা নতুন কায়দা। কিন্তু, এ বার বদলি হতেই হবে। আজন্ম কেউ এক জায়গায় থাকতে পারেন না!”
আন্দোলনের অন্যতম নেতা, ‘সারা বাংলা কুষ্ঠ কল্যাণ সমিতি’র বাঁকুড়া জেলার সাধারণ সম্পাদক রাধাবল্লভ পান্ডার প্রতিক্রিয়া, “আন্দোলনকারীদের কেউই তো কম বয়েসী নয় যে তাঁদের উস্কে দিয়ে কিছু করানো যাবে!” তাঁর পাল্টা অভিযোগ, “এটা আসলে কুষ্ঠরোগীদের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য দফতরের চক্রান্ত! আমরা যদিও বা একটু পরিষেবা পাচ্ছিলাম বাণীপ্রসাদবাবুর কাছ থেকে, সেটাও কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে।” |
কুষ্ঠরোগী মতিয়ার রহমান, সুকু গরাই, বুলু মাহাতো, পারুল দত্তরা বলছেন, “অন্য ডাক্তাররা আমাদের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে কথা বলেন। আর বাণীপ্রসাদবাবু আমাদের কাঁধে হাত রেখে কথা বলেন। উনি প্রকৃতই এক জন কুষ্ঠ-দরদি ডাক্তার।”
হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত সুপার অম্লান বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য দাবি করেছেন, “ওঁদের অভিযোগ ঠিক নয়। আমি বা অন্য চিকিৎসক, সকলেই রোগীদের গায়ে হাত দিয়েই চিকিৎসা করি।” বাণীপ্রসাদবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তিনি অসুস্থতাজনিত কারণ দেখিয়ে ছুটিতে আছেন বলে হাসপাতাল সূত্রের খবর।
এশিয়ার বৃহত্তম এই কুষ্ঠ হাসপাতালে ৫৫০টি শয্যা রয়েছে। বর্তমানে পুরুষ-মহিলা মিলিয়ে ৫৩০ জন রোগী রয়েছেন। হাসপাতালের সুপার-সহ মোট ১১ জন চিকিৎসক থাকার কথা। আছেন সাত জন।
চলতি নভেম্বরে বাণীপ্রসাদবাবুকে দক্ষিণ দিনাজপুরের গঙ্গারামপুর হাসপাতালে বদলি করে স্বাস্থ্যভবন। তা জানাজানি হতে জেলা স্বাস্থ্য দফতরে বিক্ষোভ দেখান কুষ্ঠরোগীরা। জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে স্মারকলিপিও দেন। রাধাবল্লভবাবু বলেন, “বারবার বলার পরেও স্বাস্থ্য দফতর সিদ্ধান্ত বদলায়নি। তাই এই অনশন।”
এই আন্দোলন প্রায় দু’দশক আগে বীরভূমের একটি ঘটনার স্মৃতি উস্কে দিয়েছে। তারাপীঠের তারাপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক চিকিৎসককে রাজনীতি করে বদলি করে দেওয়া হচ্ছে, ১৯৯৪ সালে এই অভিযোগে আন্দোলন করেছিলেন এলাকাবাসী। পুলিশ ও স্বাস্থ্যকর্তাদের ঘেরাও করা হয়। অ্যাম্বুল্যান্স পোড়ে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও আগুন লাগায় উত্তেজিত জনতা। পুলিশ গুলি চালায়। তিন জন মারা যান। বদলি আটকে যায় ওই চিকিৎসকের। গত বছর মঙ্গলকোটের লাখুরিয়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক চিকিৎসক বদলির প্রতিবাদেও পথে নেমেছিলেন এলাকার পুরুষ-মহিলারা।
বাণীপ্রসাদবাবুর বদলি রুখতে মরিয়া গৌরীপুরের রোগীরাও। এ দিন সকালে হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেল, কুষ্ঠরোগীদের একাংশ অনশন মঞ্চে বসে। বাকিরা হাসপাতাল সুপারের অফিসের সামনে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন। শশধর পাত্র, রবি খানরা বললেন, “ছোটখাটো অস্ত্রোপ্রচারের জন্যেও আগে বাইরে ছুটতে হত আমাদের। এখন ডাক্তারবাবুই সেই কাজ করে দিচ্ছেন। উনি বদলি হয়ে গেলে সেই সুবিধা আর পাব না।” |