কলেজ জীবন থেকেই আপনি ‘তাকে’ চেনেন। তবে পরবর্তীকালে পেশাদার আর সাংসারিক জীবনের চাপে পড়ে ভুলে গিয়েছেন। কিন্তু ভুললে চলবে না। কারণ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সে-ই ফিরিয়ে দিতে পারে মানসিক শান্তি। পুরনো দাম্পত্যে নিয়ে আসতে পারে কলেজ-প্রেমের উষ্ণতা। নবীন প্রজন্ম তাকে চেনে ‘ফ্লার্টিং’ নামে। তবে বিশেষজ্ঞদের সাম্প্রতিক দাবি, ফ্লার্টিং কিন্তু অমোঘ নিদান হয়ে দাঁড়াতে পারে অকাল জরাগ্রস্ত দাম্পত্যেও।
সম্প্রতি বিষয়টি নিয়ে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালে নিজের গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছেন কেন্টাকি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা ব্র্যান্ডি ফ্রিসবি। সেই রিপোর্টই বলছে, যে সব দম্পতি নিজেদের মধ্যে ফ্লার্ট করেন, তাঁদের বিবাহিত জীবন অন্যদের চেয়ে অনেক বেশি সুখের। কিছুটা একই মত মনোবিদ দিনাজ জিজিবয়েরও। তাঁর মতে, “দাম্পত্যে রোম্যান্স টিকিয়ে রাখতে ফ্লার্টিং জরুরি। আসলে, সুখী দাম্পত্যেও কখনও কখনও নিজেদের অনুভূতি প্রকাশ করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।”
কিন্তু কেন?
দিনাজ-এর মতে, “দীর্ঘদিনের দাম্পত্যের অভ্যাসে এসে যেতে পারে একঘেয়েমি। সেই একঘেয়েমি কাটাতেই কাজে লাগতে পারে ফ্লার্টিং।” বাস্তবিক। সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ লিখেছেন, “বিয়ে খুব বিচ্ছিরি একটা অভ্যেস। নিজের অজান্তেই দু’টো মানুষের জীবনকে বড় পানসে করে দেয়।” তা সেই পানসে দাম্পত্যের জন্য সুস্বাদু মশলা হয়ে দাঁড়াতে পারে ফ্লার্টিং। |
গায়িকা সোমলতা আচার্য চৌধুরী অবশ্য বিষয়টা নিয়ে এখনই মাথা ঘামাতে রাজি নন। সদ্যবিবাহিতা সোমলতার কথায়, “সবেমাত্র বিয়ে হয়েছে। ফলে এখনই বোধহয় বরের সঙ্গে ফ্লার্ট করার প্রয়োজন নেই আমার।” তবে মনোবিদ্যার শিক্ষিকা হিসেবে তিনিও মনে করেন, দাম্পত্য সম্পর্কে নতুনত্ব, তরতাজা অনুভূতি বজায় রাখতে গেলে কাজে লাগতেই পারে ফ্লার্টিং।
কিন্তু দাম্পত্যের বাইরে যদি পেতে চান এর স্বাদ, তা হলে? গবেষকদের একাংশের দাবি, টুক টাক হাসি বিনিময়, চোখে চোখ রাখা, কিংবা হাতের সঙ্গে হাতের উষ্ণ স্পর্শ থেকে শুরু করে মেল বা মেসেজ আদানপ্রদান সবই চলতে পারে। কিন্তু পুরোটাই নির্ভর করছে আপনার জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলো বিষয়টিকে কী চোখে দেখছেন। অতএব সাবধান! পাইকারি হারে ফ্লার্টিং চালালে কিন্তু হারাতে পারেন নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা, সতর্ক করছেন গবেষকরা।
অধ্যাপিকা ফ্রিসবি আরও জানিয়েছেন, মহিলারা ফ্লার্ট করলে পুরুষরা তাকে বেশিরভাগ সময়েই যৌন-ইঙ্গিতবাহী বলে মনে করে থাকেন। তাতে অবশ্য মহিলাদের প্রতি পুরুষদের আগ্রহ বাড়ে বই কমে না। মহিলারা অবশ্য পুরুষদের ফ্লার্টিং-এর বিষয়টিকে অনেক সময়ই ‘ভাল চোখে’ দেখেন না। ফলে দাম্পত্যের চেনা মানুষটি ছাড়া অন্য কোনও মহিলার সঙ্গে ফ্লার্ট করতে গিয়ে অনেক সময়ই তিক্ত অভিজ্ঞতা হতে পারে পুরুষদের।
কিছুটা একই মত নর্দান ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডেভ হেনিংসেনের। অন্তত পনেরোটি সমীক্ষার ফলাফল ঘেঁটে তাঁর ধারণা, মহিলা এবং পুরুষদের মধ্যে ‘ফ্লার্টিং মনস্কতার’ এই তফাৎ বেশ স্পষ্ট।
তবে হেনিংসেন জানিয়েছেন, মনস্কতার তফাৎ থাকলেও পুরুষ-নারী, দু’পক্ষই কম-বেশি ছ’টি কারণে ফ্লার্ট করে কখনও নিছক আনন্দ খুঁজতে, দাম্পত্য জীবনে খুশি নন এমন মানুষ যাঁরা, বন্ধু-সহকর্মীর কাছে নিজেকে প্রমাণ করতে, পুরনো বন্ধুত্বকে একটু উষ্ণতার ছোঁয়া দিতে, প্রকৃত জীবনসঙ্গী খোঁজার তাগিদে। হেনিংসেনের আরও দাবি, মূলত বিশেষ কোনও উদ্দেশ্য সাধনের জন্যই ফ্লার্টিং-এর পথ বেছে নেয় মানুষ। অর্থাৎ নিছক ‘টাইম পাস’ নয়, স্বার্থসিদ্ধিও হয়ে দাঁড়াতে পারে ফ্লার্টিং-এর অন্যতম কারণ।
মনোবিদ দিনাজ অবশ্য বিষয়টির সঙ্গে একমত নন। তিনি মনে করেন, সম্পর্কের মধ্যে হোক কিংবা বাইরে, ফ্লার্টিং-এ মূল ইউএসপি হল, ‘ফিল গুড’। তার পিছনে সব সময় বিশেষ স্বার্থ থাকবেই, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।
কিন্তু সম্পর্কের স্বাদ জিইয়ে রাখার এ হেন অমূল্য টোটকা নিয়ে আজও ভুরু কোঁচকান আম-ভারতীয়। এ বিষয়ে লেখিকা শোভা দে বলেন, “ফ্লার্টিংকে অনেকেই যৌনতার সঙ্গে গুলিয়ে ফেলেন। কিন্তু ফ্লার্টিং মানেই তো অশালীনতা নয়। এর অপব্যবহার বন্ধ হওয়া উচিত।” আবার সুহেল শেঠের বক্তব্য, “ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে এক জন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও নারী ফ্লার্ট করলে, অন্য কারও কী-ই বা বলার থাকতে পারে। ফ্লার্টিং মজা। খেলার মতো। এতো গম্ভীর কোনও ব্যাপার নয়।
তা হলে দাম্পত্যের বাইরেও কি ফ্লার্টিং একই রকম ভাবে গ্রহণযোগ্য?
তর্ক চলতেই পারে। তবে মনোবিদদের একাংশের মতে, দাম্পত্যের ভিতর ফাটল বা ফাঁক থাকলেই সম্পর্কের বাইরে গিয়ে ফ্লার্টের স্বাদ পেতে চান কেউ কেউ। অর্থাৎ দাম্পত্যে চিড় ধরেছে কি না, তারও হদিস দিতে পারে ফ্লার্টিং।
তাই বোধহয় জেন এক্স-এর কাছে ইতিমধ্যেই নয়া আর্ট অফ লিভিং হয়ে উঠেছে ফ্লার্টিং। প্রৌঢ় প্রজন্ম কী ভাবে তাকে গ্রহণ করে, সেটাই দেখার। |