সরকারের টালবাহানায় তৈরি হচ্ছে সংশয়
ধর্ষণ কি না, জানা গেল না দু’দিনেও
বারাসতে মহিলা খুন হওয়ার আটচল্লিশ ঘণ্টা পরেও সবিস্তার জানা গেল না, তাঁর উপরে কী ধরনের অত্যাচার হয়েছে। পুলিশের বক্তব্য, নিহতের ময়না-তদন্ত এবং দেহের বিভিন্ন নমুনার ফরেন্সিক তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট না-আসায় নিশ্চিত ভাবে বলা যাচ্ছে না, তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কি না।
কিন্তু শনিবারের ঘটনাটির প্রতিবাদে রবিবার যাঁরা বারাসতের রাস্তায় নেমেছিলেন, তাঁদের অনেকেই এই বিলম্বের প্রেক্ষিতে প্রশাসনের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। টালবাহানা করে প্রশাসন পুরো ব্যাপারটা ধামাচাপা দিতে চাইছে কি না, সেই সংশয়ও তৈরি হয়েছে বিভিন্ন মহলে। বিশেষত রাজ্যের নগরোন্নয়নমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের মন্তব্যের জেরে বিষয়টি অন্য মাত্রা পেয়ে গিয়েছে।
বারাসতের সোনাখড়কি গ্রামের ওই ঘটনাটিকে ‘পারিবারিক বিবাদের জের’ হিসেবে রবিবার প্রকাশ্যে অভিহিত করেছেন ফিরহাদ। তদন্ত শুরু না-হতেই খোদ মন্ত্রীর মুখে এ হেন মন্তব্য আমজনতার একাংশের মনে সংশয় তৈরি করেছিল। মহিলার উপরে অত্যাচারের ‘ধরন’ প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক বিলম্বে তা আরও বেড়েছে। যা এ দিন উস্কে দিয়েছেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা, সূর্যকান্ত মিশ্র। এ দিন বসিরহাটে সূর্যবাবু বলেন, “সরকারকে হুঁশিয়ারি দিচ্ছি। শুনছি, পুলিশ-প্রশাসন-চিকিৎসকদের উপরে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। প্রয়োজনে এ রাজ্যেও দিল্লির মতো প্রতিবাদ হবে। আমরা সামনেই থাকি বা পিছনে, এ সব রুখে দেব।”
ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা কিংবা ফরেন্সিক রিপোর্ট প্রকাশের ইচ্ছাকৃত বিলম্বের অভিযোগ অবশ্য পুলিশ-কর্তারা উড়িয়ে দিচ্ছেন। তাঁদের দাবি: বিশেষ দল গড়ে নিহতের ময়না-তদন্ত হয়েছে। সব নমুনা ফরেন্সিকে পাঠানো হয়েছে। সেই রিপোর্ট না-পেলে নির্দিষ্ট ভাবে জানা সম্ভব নয় যে, মহিলাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল কি না। কিন্তু ফরেন্সিকের রিপোর্ট আসতে কিছু দিন সময় লাগবে। তাই নিশ্চিত না-হওয়া পর্যন্ত এমন সংবেদনশীল একটি বিষয়ে চটজলদি কোনও মন্তব্য তাঁরা করতে চাইছেন না বলে জানিয়েছেন রাজ্যের একাধিক পুলিশ-কর্তা। যদিও ঘটনাটির ‘কারণ’ সম্পর্কে ফিরহাদের আগাম মতামত প্রকাশ করে দেওয়ায় পুলিশের একাংশ বিব্রতও। “আমরা যখন তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে ব্যস্ত, তখন রাজ্যের এক জন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী এ হেন মন্তব্য না-করলেই পারতেন।” আক্ষেপ করেছেন উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পুলিশের এক অফিসার।
বস্তুত ইদানীং কোনও অনভিপ্রেত ঘটনার পরেই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা যে ভাবে তদন্তের ‘ফলাফল’ আগাম ঘোষণা করে দিচ্ছেন, তাতে পুলিশের সমস্যাই হচ্ছে বলে ঠারেঠোরে স্বীকার করছেন অনেক পুলিশ অফিসার। এক জনের কথায়, “বীরভূমের লোবায় তদন্ত শুরুর আগেই মুখ্যমন্ত্রী বলে দিলেন, পুলিশ গুলি চালায়নি! পার্ক স্ট্রিটকে বললেন সাজানো ঘটনা! অথচ তদন্তে ধর্ষণ প্রমাণিত হওয়ায় কলকাতা পুলিশের তখনকার গোয়েন্দা-প্রধান দময়ন্তী সেনকে সরতে হল।” বিজেপি-র রাজ্য সভাপতি রাহুল সিন্হাও রাজ্যপালকে চিঠি লিখে অভিযোগ করেছেন, ধর্ষণের বিভিন্ন মামলায় মন্ত্রী ও প্রশাসনের কর্তাদের মনোভাব ও কিছু ক্ষেত্রে তাঁদের মন্তব্য ধর্ষকদেরই সাহস বাড়িয়ে দিচ্ছে।
এবং পুলিশ-প্রশাসনের একাংশের মতে, বারাসত-কাণ্ডে সেই ট্র্যাডিশনই বহাল থেকেছে। নগরোন্নয়নমন্ত্রীর মন্তব্য এ ক্ষেত্রে তদন্তকে প্রভাবিত করতে পারে এমন সম্ভাবনাও একেবারে উড়িয়ে দিচ্ছে না এই মহল। কার্যত যার একটা ইঙ্গিত ইতিমধ্যে মিলেছে বলে তাদের দাবি। কী রকম?
অভিযোগ, নিহত বধূর স্বামীকেই কাঠগড়ায় তোলার একটা চেষ্টা শুরু হয়েছে। তবে উল্টো দিকে বারাসতের সাধারণ মানুষের দিক থেকেও যে সত্য উদ্ঘাটনের বিরাট চাপ পুলিশ-প্রশাসনের মাথায় রয়েছে, তদন্তকারীরাই তা জানাতে দ্বিধা করছেন না। ওঁদের এক জনের বক্তব্য, “রবিবার সন্ধ্যায় বারাসতে নাগরিকদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ মিছিলের পরে প্রশাসন এখন ভীষণই সতর্ক। তাই মহিলার মৃত্যু কী ভাবে হল, তাঁর উপরে শারীরিক নির্যাতন হয়েছে কি না, এ সব প্রকাশ করার আগে যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করে নিতে চাইছেন কর্তারা।” এক তদন্তকারী অফিসার এ-ও জানাচ্ছেন, সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ধর্ষণের সংজ্ঞাই বদলে গিয়েছে। যৌনাঙ্গে আঘাতের চিহ্ন না-থাকলেও বলা যাবে না যে, ধর্ষণ হয়নি। বিশেষত মহিলার নিষ্প্রাণ, বিবস্ত্র শরীরটি কেন শুধু একটা কাপড়ে ঢাকা দেওয়া ছিল, সেটাও তদন্তকারীদের অন্যতম বিবেচ্য।
শনিবার রাতে বারাসতের জগন্নাথপুরে সোনাখড়কি গ্রামের ইটভাটার কাছে বছর পঁয়তাল্লিশের ওই গৃহবধূ আক্রান্ত হয়েছিলেন। ভাটা লাগোয়া পুকুরের কাছে তাঁর দেহ পাওয়া যায়। নিহতের ছেলের অভিযোগের ভিত্তিতে পুলিশ খুন ও ধর্ষণের মামলা রুজু করে। দুষ্কর্ম রুখতে গিয়ে তাঁর স্বামীও গুরুতর জখম হন বলে অভিযোগ। রবিবারই পুলিশ ইশা মোড়ল নামে এক জনকে গ্রেফতার করে। পুলিশ-সূত্রের খবর, ইশা ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ ইটভাটার শ্রমিকদের থেকে তোলা তুলত, চোলাইয়ের ঠেক চালাত। সন্দেশখালির বাসিন্দা ইশা আর কোন কোন অপরাধে জড়িত, পুলিশ তা দেখছে।
পরিস্থিতির গুরুত্বের নিরিখে বারাসত-কাণ্ডের তদন্তভার এ দিন সিআইডি-কে দেওয়া হয়েছে। তারাও ইশাকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে জেরা করবে। সিআইডি-সূত্রের খবর, মহিলাকে একাধিক অস্ত্রে কোপানো হয়েছিল কি না, তা জানতে বিশেষজ্ঞ-চিকিৎসকদের পরামর্শ চাওয়া হয়েছে। গোয়েন্দাদের অনুমান, খুনের সময়ে একাধিক অস্ত্র ব্যবহার হয়ে থাকলে দুষ্কৃতীর সংখ্যাও একাধিক হওয়ার সম্ভাবনা। তদন্তের স্বার্থে যে সংখ্যাটা জানা অত্যন্ত জরুরি। মহিলার দেহের কোথায় কোথায় আঘাতের চিহ্ন রয়েছে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের তা-ও ফের যাচাই করতে বলা হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে গোয়েন্দাদের দিশা দিতে পারতেন ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী, অর্থাৎ মহিলার স্বামী। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ওই ব্যক্তি আপাতত কিছু বলার অবস্থায় নেই। আরজিকর হাসপাতাল সূত্রের খবর: মাঝে মাঝে জ্ঞান ফিরে এলে তিনি গোঙাচ্ছেন। কখনও বলছেন, ‘ওরা জোর করে অ্যাসিড খাইয়ে দিয়েছে।’ কখনও বলছেন, ‘আমাকে খুব মেরেছে।’ অ্যাসিডের তেজে ৫২ বছরের বয়সী প্রৌঢ়ের পাকস্থলী ও খাদ্যনালীর অনেকটাই পুড়ে যাওয়ায় রবিবার তাঁকে আইটিইউয়ে রাখা হয়েছিল। এ দিন স্থানান্তরিত করা হয় পোস্ট অ্যানাস্থেটিক কেয়ার ইউনিটে। যন্ত্রণা কমাতে কড়া ডোজের ঘুমের ওষুধ দেওয়া হচ্ছে। উনি কত দিনে কথা বলার মতো অবস্থায় আসবেন?
আরজিকরের ডেপুটি সুপার সিদ্ধার্থ নিয়োগী বলেন, “সময় লাগবে। মুখ থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত অ্যাসিডে পুড়ে গিয়েছে। আগামী দিন পনেরো গলা দিয়ে জল-ও দেওয়া যাবে না। একই কারণে রাইল্স টিউব বা এন্ডোস্কোপ ঢোকানো যাচ্ছে না। ভিতরের পোড়ার ক্ষত যতক্ষণ না স্বাভাবিক ভাবে শুকোচ্ছে, ততক্ষণ কোনও অস্ত্রোপচারও করা যাবে না। সামান্য ধাক্কায় খাদ্যনালী বা পাকস্থলী ফুটো হয়ে টানা রক্তবমি শুরু হতে পারে।”

জবাব নেই
• দু’দিনেও কেন মেলেনি ময়নাতদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট
• কী ধরনের অত্যাচার হয়েছিল, কেন তা জানা গেল না
• মহিলার পরনের জামাকাপড় কোথায় গেল
• হামলাকারীদের সংখ্যা জানা গেল না কেন
• মন্ত্রী কেনই বা আগ বাড়িয়ে পারিবারিক বিবাদ বললেন

বার বার বারাসত
দিন কী হয়েছিল গ্রেফতার কত মামলার হাল
১৪ ফেব্রুয়ারি ২০১১ দিদির সম্মান বাঁচাতে গিয়ে খুন রাজীব দাস ৩ জন চার্জশিট
২ অগস্ট ২০১১ পুলিশ পরিবার আক্রান্ত ডিএম অফিসের কাছে ১ জন চার্জশিট
২ সেপ্টেম্বর ২০১১ ডিএম অফিসের সামনেই পুলিশকে গুলি ১ জন চার্জশিট
২৭ এপ্রিল ২০১২ ছাত্রীকে অপহরণ, মুক্তিপণ দিয়ে উদ্ধার অভিযুক্ত ফেরার চার্জশিট হয়নি
২৭ জুলাই ২০১২ স্টেশনে ছাত্রীকে কটূক্তি, প্রহৃত বাবা ৩ জন (অধরা ১) চার্জশিট
২০ অগস্ট ২০১২ কিশোরীর শ্লীলতাহানি ৪ জন চার্জশিট
২১ অগস্ট ২০১২ পানশালা-গায়িকা গণধর্ষিতা বামনগাছিতে ৫ জন চার্জশিট
৩১ অগস্ট ২০১২ মেয়ের শ্লীলতাহানি, মা-কে প্রহার ১ জন (ফেরার ১) চার্জশিট হয়নি
৩ সেপ্টেম্বর ২০১২ শ্লীলতাহানি রুখতে গিয়ে ডাক্তার খুন ২ জন চার্জশিট
২৯ ডিসেম্বর ২০১২ ইটভাটা-কর্মী মহিলাকে নির্যাতন করে হত্যা ১ জন তদন্ত চলছে



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.