বৃষ্টি পর্যাপ্ত হয়নি, আকাল শীতের মাছে
মাছ খাওয়াকে কে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখল কি না দেখল, তাতে বাঙালির ভারি বয়ে গিয়েছে। বারোমাসই তার ভাতের পাতে মাছ চাই। এবং ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে খাদ্যতালিকায় নানা পরিবর্তনের হাত ধরে বদলে যায় মাছের রকমও। সেই সঙ্গেই বদলায় পদের ধরন ও স্বাদও। যেমন বর্ষায় ইলিশের নানা পদ হয়, তেমনই শীতকালে বাঙালির প্রিয় পদে উঠে আসবে চিতল মুইঠ্যা, তেলকই, সরপুঁটির ঝাল চচ্চড়ি কিংবা ফুলকপি’র সঙ্গে ভেটকি মাছে। তাই ফুলকপি, নলেনগুড়ের সঙ্গে সঙ্গে শীতের রান্নাঘরে ভিড় করে থাকে নানা রকমের মাছও।
গবেষকেরা জানাচ্ছেন, শীতের মাছের কদর বরাবরই বেশি। বারাসত সরকারি কলেজের জীববিদ্যার শিক্ষক ও গবেষক দেবজ্যোতি চক্রবর্তী বলেন, “শীতের মাছের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য হল প্রচুর তেল বা চর্বি থাকে এই সময়ের মাছের দেহে। বর্ষার পরে থেকে জলের খাদ্যগুণও বেড়ে যায়।” বর্ষার জলে ভেসে আসা প্রাণীজ এবং উদ্ভিজ খাবারের পরিমাণ জলে প্রচুর থাকে বলে শীতকালে মিঠে জলের মাছের স্বাদ খুবই ভাল। শীতে তাই খুবই তৃপ্তি করে খাওয়া যায় সরপুঁটি। এই সময়ের মাছের বৈচিত্র্য কত, তা বোঝা যায় কেবল বাটা মাছ দেখলেই। সাধারণ বাটা তো রয়েইছে, রাগ বাটা এবং ভাগ্নে বাটা শীতের সময়েই মেলে।
শীতকালে মিষ্টি জলের নানা ধরনের মাছ পাওয়ার পিছনে প্রাকৃতিক কারণ আরও রয়েছে। বর্ষাকালে প্রজননের তাগিদে মিঠে জলে আসে। তারা ডিম পাড়ার জন্য বেছে নেয় নদীর প্রবহমান জলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত অথচ সরাসরি স্রোত নেই এমন খাল, বিল, বাওর, ঝিল ইত্যাদিতে।” তারা সেখানে ডিম পেড়ে চলে যায়। তারপরে সেই ডিম ফুটে অসংখ্য পোনার জন্ম হয়। তারা সেখানেই বড় হয়। যেগুলির কিছু শীতকালে জল কমলে ধরা যায়। দীর্ঘদিন ধরেই এই মাছের উপরেই নির্ভর করত গ্রাম বাংলার মানুষ। দেবজ্যোতিবাবু বলেন, “বাঙালির প্রিয় কিছু মাছ আমিষাশী। তারা ওই পোনা মাছগুলি খেয়েই পুষ্ট হয়। যেমন বোয়াল, চিতল, মাগুর, শোল বা কই। ফলে এই সব ধরনের মাছই শীতকালে ভাল পাওয়া যায়।”
শীতের সন্ধ্যায় মাছ ধরতে। —নিজস্ব চিত্র।
সেই সব মাছেরই আকাল দেখা যাচ্ছে। মৎস্যজীবী শম্ভু রাজবংশী বা পরেশরাম রাজবংশী বলেন, এই সব মাছ এখন কম পাওয়া যায়। তাতে তার দাম যা বাড়ছে, তা সাধারণ মধ্যবিত্তের সীমার বাইরে চলে যাচ্ছে। তার প্রধান কারণ, বেশিরভাগ খাল বিল বাওর আর রক্ষা করা যাচ্ছে না। যেখানে ছোট ছোট নদী পর্যন্ত বুজে যাচ্ছে, যেখানে অন্য বড় নদী থেকে বর্ষায় মাছ যেত, সেখানে ছোট জলাশয় যে রক্ষা পাবে না, তা বলাই বাহুল্য।
মৎস্যজীবী পরেশনাথ রাজবংশী বলেন, “কোথায় মাছ? নদীতে তো জলই নেই। বড় বড় হ্রদের জল শুকিয়েছে। যে সব হ্রদের সঙ্গে নদীর সংযোগ ছিল, সেই সব সংযোগস্থল পর্যন্ত শুকিয়ে গিয়েছে। শীতকালে তাই জেলে না খেয়ে থাকে।” তাঁর কথায়, “বর্ষাকালে নদীতে জল না এলে মাছও আসবে না।” কমে আসা জলাভূমি, বদলে যাওয়া আবহাওয়ায় তাই মিঠে জলের মাছ ক্রমশ কমছে। অক্ষয় রাজবংশী বলেন, “সারা রাত জাল ফেলে রোজগার বড়জোর ৭০ টাকা। ক’দিন পরে এইটুকুও হবে না।”
অথচ এই মাছেরই কদর ছিল কি প্রচণ্ড, তার প্রমাণ রয়েছে শাস্ত্রে ও সাহিত্যে। প্রাকৃত পৈঙ্গলে যার ভাতের পাতে ‘মোইলি মচ্ছা’ পড়ত, তাকে ‘পুণ্যবন্তা’ বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। এই মইলি মাছ সুকুমার সেনের মতে ময়না মাছ। বৃহদ্ধর্মপুরাণে উল্লেখ করা হয়েছে রোহিত বা রুই, শফর বা পুঁটি, সকুল বা শোল মাছের কথা। প্রাণীজ এবং উদ্ভিজ তেল বা চর্বির কথা বলতে গিয়ে জীমূতবাহন ইলিশ মাছের তেলের বহুল ব্যবহারের কথা বলেছেন। যে কারণেই বাঙালির স্মৃতিকার ভট্টভবদেব বা শ্রীনাথাচার্য সুদীর্ঘ যুক্তি তর্ক উপস্থিত করে বাঙালির মাছ খাওয়ার ব্যাপারে সওয়াল করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে যখন বৌদ্ধ ও জৈন প্রভাবে খাদ্যের জন্য প্রাণিহত্যার বিরুদ্ধে আপত্তি দানা বাঁধছিল, তখনও বাঙালির মাছ-ভাতের পক্ষে সমর্থন জুগিয়েছেন সমাজকর্তারা।
‘বারিবহুল, নদনদী-খালবিল বহুল... বাংলায় মৎস্য অন্যতম প্রধান খাদ্যবস্তু রূপে পরিগণিত হইবে, ইতা কিছু আশ্চর্য নয়।...বাংলাদেশের এই মৎস্যপ্রীতি আর্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি কোনদিনই প্রীতির চক্ষে দেখিত না, আজও দেখে না, অবজ্ঞার দৃষ্টিটাই বরং সুস্পষ্ট।”
প্রাচীন বাংলায় যার ভাতের পাতে ‘মোইলি মচ্ছা’ পড়ত, তাকে ‘পুণ্যবন্তা’ বলে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। বৃহদ্ধর্মপুরাণে উল্লেখ রয়েছে রোহিত বা রুই, শফর বা পুঁটি, শোল মাছের কথা। জীমূতবাহন ইলিশ মাছের তেলের বহুল ব্যবহারের কথা বলেছেন।
“জলাশয় কমে আসছে। যেটুকু রয়েছে, তাতেও কোথাও পাট পচানো হচ্ছে। অন্য জায়গায় জলে মিশছে কীটনাশক। তাই মাছের প্রজননের হার কমছে।”
গৌতম সরকার,
এখন কী অবস্থা? নবদ্বীপ ব্লক কৃষি আধিকারিক বীরেশ্বর চক্রবর্তী বলেন, “বর্ষার জল যেহেতু কম হচ্ছে, তাই তখনই মাছের বৈচিত্র্য কম হচ্ছে। যার ফলে সেই জলে যে সব মাছের বাড়বৃদ্ধি ঘটে, স্বাভাবিক ভাবেই তার পরিমাণ কমে যাচ্ছে।” তাঁর কথায়, “মাছের জন্য যত বৃষ্টি হওয়া দরকার, বেশ কয়েক বছর ধরেই তা হচ্ছে না।” সেই সঙ্গে তিনি বলেন, “শীতের যে সব মাছের কথা উঠছে, সেগুলি কখনওই বিজ্ঞানসম্মত ভাবে চাষ করা হয়নি, সে কথা ভাবেনওনি কেউ। অন্য দিকে জনসংখ্যা বেড়েছে, বৃষ্টি কমেছে, জলাশয় বুজেছে। তার ফলে শীতের মিঠে জলের মাছ কমছে।” সরকার কি ভাবছে? বীরেশ্বরবাবু বলেন, “এই মাছগুলি বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন হ্যাচারিতে এই সব মাছ দেওয়া হচ্ছে চাষ করার জন্য। তাই বাজারে একেবারে অমিল নয়। তবে দাম হয়তো বেশি। তবে ভবিষ্যতে কিছুটা হলেও সেই জোগান বাড়বে বলে আশা করা যায়।”
সদ্য অসরপ্রাপ্ত রাজ্য মৎস্য যুগ্ম অধিকর্তা গৌতম সরকারের মতে, “এই মাছগুলি কমে আসছে সেটা সত্যি কথা। সরকার নানা প্রকল্প নিয়েছে। খোঁজ করা হচ্ছে কোথায় কোথায় এই ধরনের মাছ বেশি পাওয়া যায়। সেখান থেকে মাছ নিয়ে তা মৎস্যচাষিদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.