মুম্বইয়ের যৌনপল্লি থেকে উদ্ধার হওয়া ১১ জন যুবতী পালালেন উত্তরপাড়ার সরকারি হোম থেকে। রবিবার গভীর রাতে বিষয়টি ধরা পড়ে বলে হোম কর্তৃপক্ষ পুলিশকে জানিয়েছেন। গত ১৮ ডিসেম্বর একই জায়গা থেকে উদ্ধার হওয়া আরও দু’জন এই হোম থেকে পালিয়েছিলেন। রাজ্যের নারী ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী সাবিত্রী মিত্রের মন্তব্য, “মেয়েগুলো হোমে থাকার মতো নয়। ওরা পালানোর জন্য ব্যস্ত হয়েছিল! ওরা নাছোড়বান্দা, পাজি।”
কী ভাবে এ তথ্য জানলেন? মন্ত্রীর জবাব, “হোমের অবস্থা দেখার জন্য জেলাস্তরে যে নজরদারি কমিটি রয়েছে, তারা ওই হোম ঘুরে এসে এই রিপোর্ট দিয়েছিল। ওরা মুম্বই যাওয়ার পরিকল্পনা ছকছিল।”
তার পরেও এই ঘটনার জেরে প্রশ্ন উঠেছে, ওই হোমে পাহারা বা নজরদারি বাড়াতে কতটুকু উদ্যোগী হয়েছিল সরকার? সমাজকল্যাণ দফতরের কর্তারা সোমবার ওই হোম ঘুরে স্বীকার করেছেন, নিরাপত্তা-ব্যবস্থা একেবারেই অপ্রতুল। দু’জন গার্ড আর দুই পুলিশকর্মী। তা-ও পুলিশকর্মীরা সব সময় থাকেন না। হোমের এক মহিলা কর্মী এবং রাত পাহারাদারকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করেছে পুলিশ।
আরও বড় প্রশ্ন উঠেছে এ ধরনের মহিলাদের ‘যথাযথ’ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না করে হোমে রাখা নিয়ে। সেই সঙ্গে মন্ত্রীর মন্তব্য নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছে রাজ্য মহিলা কমিশন। কমিশনের চেয়ারম্যান সুনন্দা মুখোপাধ্যায়ের কথায়, “মন্ত্রী বলেছেন, ‘মেয়েরা পাজি, ওরা পালানোর জন্য ব্যস্ত হয়েছিল’। বন্দি করে রাখলে, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা না হলে কেন মেয়েরা পালাবেন না?” |
গোটা মহারাষ্ট্র, বিশেষ করে মুম্বই শহরের যৌনপল্লিগুলিতে নিয়মিত ভাবে তল্লাশি চালিয়ে তরুণী-যুবতীদের উদ্ধার করছে সে রাজ্যের পুলিশ। তাঁদের মধ্যে বাংলাভাষীদের ক্ষেত্রে অনেককে সন্দেহ করা হচ্ছে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে। কিন্তু তাঁদের অনেকে দাবি করছেন তাঁরা পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। ফলে, তাঁদের পাঠানো হচ্ছে এ রাজ্যে। সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত একটি বেসরকারি হোমের সঙ্গে জড়িত বৈতালি গঙ্গোপাধ্যায় জানান, বিধি অনুযায়ী, উদ্ধার হওয়া মহিলা পশ্চিমবঙ্গের কি না, তা প্রাথমিক ভাবে রাজ্য সরকারকে তদন্ত করতে দেখতে বলার কথা মহারাষ্ট্র সরকারের। কিন্তু কার্যত সেই তদন্তের রিপোর্ট পাওয়ার জন্য অপেক্ষা না করেই উদ্ধার হওয়া বাংলাভাষী মহিলাদের পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে, যাঁদের মধ্যে বাংলাদেশিদের থাকার সম্ভাবনাও থাকছে। রবিবার নিখোঁজ হওয়া ১১ জনের মধ্যেও বাংলাদেশের তিন জন রয়েছেন। বাকিদের বাড়ি উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া এবং মুর্শিদাবাদে।
প্রশাসন সূত্রের খবর, গত ২৩ নভেম্বর সমাজকল্যাণ দফতর ১৮ জন মহিলাকে উত্তরপাড়া স্টেশনের অদূরে সরকারি হোমটিতে পাঠায়। তাঁদের বয়স ২৮ থেকে ৪০ এর মধ্যে। সবাইকে মুম্বইয়ের বি কে মার্গ নিষিদ্ধপল্লি থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। মুম্বইয়ের আদালত নির্দেশ দেয়, আত্মীয়দের খুঁজে বার করে তাঁদের হাতে এঁদের তুলে দেওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
উত্তরপাড়ার হোম কর্তৃপক্ষ এবং শ্রীরামপুর মহকুমা প্রশাসন এই মহিলাদের নিয়ে শুরু থেকেই আতান্তরে পড়ে। কেননা, উত্তরপাড়ার হোমে নাবালিকারা থাকে। অনেকে পড়াশোনাও করে। তাই প্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সেখানে রাখতে চায়নি প্রশাসন। কিন্তু দু’বারের চেষ্টাতেও মুম্বই থেকে উদ্ধার হওয়া মহিলারা অন্যত্র যেতে রাজি হননি। মহকুমাশাসক জয়সি দাসগুপ্ত বলেন, “ওঁরা অন্যত্র যেতে রাজি না হওয়ায় আদালতের কথামতো আত্মীয়দের খোঁজ করার চেষ্টা চলছিল। তা নিয়ে শুনানিও শুরু হয় গত সপ্তাহে। তার আগেই এই ঘটনা!”
হোমের রাত পাহারাদার পুলিশকে জানান, রাত আড়াইটে পর্যন্ত তিনি দেখেছিলেন, সব স্বাভাবিক আছে। ঘণ্টাখানেক পরে দেখেন, দোতলার একটি ঘরের গ্রিল কাটা। ১১ জন উধাও।
উত্তরপাড়ার হোমটির মূল প্রবেশ দরজা থেকে মূল ভবনে পৌঁছতে গেলে দু’টি গ্রিলের গেট পেরোতে হয়। প্রায় ১২ ফুট উঁচু পাঁচিলে পেরেক, কাচ বসানো। ফস্কা গেরোটা কোথায়? এ দিন দেখা গেল, হোমের পিছন দিকে বিএন রোড বরাবর পাঁচিলে প্রায় ছ’ফুট জায়গায় পেরেকও নেই, কাচও নেই। তদন্তকারীদের ধারণা, ভিতর থেকে মই দিয়ে পাঁচিলে উঠে, ওই জায়গা দিয়েই পালিয়েছেন ১১ জন। ভিতরের কারও সাহায্য না পেলে, কী ভাবে গ্রিল কেটে তাঁরা পালালেন সে প্রশ্নও উঠেছে। মন্ত্রীও এ ব্যাপারে আলাদা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
তবে সাবিত্রীদেবীর বক্তব্য, “শত ব্যবস্থা নিয়েও কিছু করা যেত কি না সন্দেহ, কারণ, এই মেয়েদের পালিয়ে যাওয়ার প্রবণতা সব সময় থাকে।” হোম পরিচালনায় জড়িত বৈতালিদেবীর ব্যাখ্যা, “এ ধরনের মহিলারা মুম্বইয়ে মাসে ২০-২৫ হাজার টাকা রোজগার করেন। হাওলার মতো এক ব্যবস্থার মাধ্যমে সেই টাকা এঁরা নিজেদের আত্মীয়দের কাছে পাঠান। হোমে থাকলে সে সব বন্ধ হয়ে যায়।”
হুগলিরই গুড়াপের হোমে আবাসিক গুড়িয়ার দেহ উদ্ধার হওয়ার পরে রাজ্যের হোমগুলির দশা নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়েছিল। সেই সময়ে হোমগুলি কী ভাবে পরিচালিত হচ্ছে, মেয়েদের কোনও ক্ষোভ আছে কি না, সে সব দেখার জন্য জেলাস্তরে নজরদারি কমিটি তৈরি হয়েছিল। জেলার মান্যগন্য কিছু ব্যক্তি, এসপি-ডিএসপি-ডিএমদের স্ত্রীদের ওই কমিটিতে রাখার কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে অধিকাংশ জেলায় ওই কমিটি এখনও গঠনই হয়নি, হলেও তাদের কাজের অবস্থা তথৈবচ বলে অভিযোগ।
|