প্রবন্ধ...
আর কবে সতর্ক হব?
ন্মের পর পরই কলকাতার দুর্নাম ছিল ভয়ঙ্কর সব অগ্নিকাণ্ডের জন্য। তখনকার কলকাতার খড়ের চালের কুঁড়েঘরগুলোই এ জন্য মূলত দায়ী ছিল। হাটখোলার মহাজনদের অনেকেরই খোলার তৈরি দোতলা মাঠগুদাম ছিল। সুতরাং অগ্নিকাণ্ড খুব বেশিই হত। সে সময় প্রায় ফি-সপ্তাহেই কলকাতায় আগুন লাগত। ১৭৮০ সালের কথাই ধরা যাক। সে বছর মার্চ মাসের অগ্নিকাণ্ডে কলকাতায় ১৫,০০০ খড়ের ঘর ধ্বংস হয়। পরের মাসেই বউবাজারে ৭০০ কুঁড়েঘর পুড়ে যায়। মেছুয়াবাজার ও হরিণবাড়ি (এখানেই তখন জেলখানা ছিল) এলাকাতেও বিরাট বিরাট অগ্নিকাণ্ড ঘটেছিল সে বছর।
পুরনো কলকাতায় আতশবাজিরও রমরমা ছিল। মইনুদ্দিন বারুদওয়ালা আতশবাজি তৈরি করতেন। তাঁকে ১৭৩৮-এ বাজি তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তখনকার কলকাতায় অনেক বড় বড় অগ্নিকাণ্ডের পেছনে ছিল আতশবাজি। হাউই থেকে চালাঘরে আগুন লেগে পল্লির পর পল্লি ছাই হয়ে যেত। এ ছাড়া মাঝে মাঝেই আগুন লাগত পাটকলগুলোতে। হাউই-এর এ হেন কাণ্ড দেখে সাহেবরা নড়েচড়ে বসলেন। ঠিক হল, কলকাতার মধ্যে আর আতশবাজি ছুড়তে দেওয়া হবে না। বাজির দোকানগুলি তুলে দেওয়ার প্রস্তাব হল। মইনুদ্দিন পড়লেন ফাঁপড়ে। তিনি দরখাস্ত করলেন, হাউই ছাড়া অন্য বাজি তৈরি করবেন। তাঁর অনুমতি মঞ্জুর হল।
কলকাতায় তখন কিছু মানুষ ইচ্ছে করেই আগুন লাগাত। উদ্দেশ্য লুঠপাট। আগুন লাগানোর কায়দাও ছিল অদ্ভুত। নারকেলের মালার ভেতর আগুন রেখে তাতে এক টুকরো ইট বেঁধে দেওয়া হত। বাতাস ঢোকার জন্য মালায় দুটো ফুটো থাকত, যাতে আগুন ছড়াতে পারে। ১৭৮৯-তে এক ব্যক্তি ধর্মতলায় আগুন লাগাতে গিয়ে ধরা পড়েছিল। কিন্তু তাকে ধরতে সকলের কালঘাম ছুটে যায়। সারা শরীরে সে আচ্ছা করে তেল মেখে রেখেছিল। সেই ঘটনার পর সুপারিশ করা হয়, এই দুষ্কৃতীদের ধরার জন্য খড়ের ঘরের মালিকদের তিনটি আঁকশিযুক্ত লম্বা বাঁশ রাখতে হবে।
তখনকার দিনে বাড়িগুলো ছিল একটানা। বাড়ির এক প্রান্ত হয়ত শুরু হয়েছে বউবাজার এলাকায়। আর এক প্রান্ত হয়তো কলেজ স্ট্রিটে। তাই এক দিকে আগুন লাগলে অন্য প্রান্তে বাড়ি ভাঙা শুরু হয়ে যেত। কখন কোথায় আগুন লাগছে তা জানার জন্য এক অদ্ভুত উপায় বার করা হয়েছিল। উঁচু কোনও বাড়ির চালে টঙ-এর উপর এক জন পাহারায় থাকত। ধোঁয়া দেখলেই সে খবর দিত ও উদ্ধারের কাজও শুরু করে দিত। সঙ্গে থাকত জলের বালতি আর মাটি। আগুন দেখলেই সেই মাটি ভিজিয়ে সর্বাঙ্গে কাদা মেখে কুঁড়ের ভেতর ঢুকে পড়ত। আগুনের আঁচে মাটি শুকিয়ে গেলে বাইরে বেরিয়ে তা আবার জল দিয়ে ভিজিয়ে নিত।

কলকাতায় আগুন: ২০১২
১ জানুয়ারি
• পার্ক স্ট্রিটে এপিজে হাউসের আটতলার সার্ভিস রুমে।

২২ জানুয়ারি
• বাইপাসে কালিকাপুরের বস্তিতে।
১৭ জানুয়ারি

• ক্যামাক স্ট্রিটের পেট্রোল পাম্পে।
১৯ ফেব্রুয়ারি
• ট্যাংরায় একটি কারখানায়।

২৯ ফেব্রুয়ারি
• বরানগর জুটমিলে।
২২ মার্চ

• হাতিবাগান বাজার।

২৬ মার্চ
• সেক্টর ফাইভের দুটি বহুতলে।
১২ মে
• ভিআইপি রোডে কোল ইন্ডিয়ার আবাসনে।

২২ মে
• বেলেঘাটায় সরকার বাজারের ২০-২৫টা দোকানে।

১৬ জুন
• বেলেঘাটার পাগলাডাঙা রোডের বস্তিতে।

১৩ জুলাই
• শিবপুরের কাপড়ের গুদামে (উপরের ছবি) আর হাওড়ার শাজাহান মার্কেটে আগুন লাগে।
২৫ সেপ্টেম্বর
• মণি স্কোয়ার মলে।
২৫ অক্টোবর
• এসএসকেএম-এর রেডিয়োলজি বিভাগ
থেকে ধোঁয়া বেরতে দেখা যায়।

৩ নভেম্বর
• ওল্ড চায়না বাজার চুড়ির দোকান ও গোডাউনে।

২৪ নভেম্বর
• এসএসকেএম হাসপাতালের শিশু বিভাগে।
৭ ডিসেম্বর
• গোলপার্কে ফিল্ম ল্যাব-এ।

১৮২১-এর ২১ এপ্রিলের একটি প্রতিবেদন বলছে, লালবাজারে এক মন্দিরের সামনে চটের পর্দার নীচে ধুনা পোড়ার সময় আগুন ধরে। কাছেই মদের দোকানে তখন ভিড় জমিয়েছিল ফিরিঙ্গিরা। ‘শ্রীযুত ডিকষ্টা সাহেবের মদের গুদামে অগ্নি প্রজ্বলিত হইল তাহার নিকটে জাহাজি গোরা অনেক ছিল তাহারা দেখিয়া আপন শরীরের বস্ত্র ত্যাগ করিয়া সর্ব্বাঙ্গে কর্দ্দম মাখিল এবং অগ্নির মধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া গুদামের চাল ভাঙিল পরে দমকল আনাইয়া গোরারদের গায় ও অগ্নিতে জল দিতে লাগিল।’
এই গোরা নাবিকরা পুরনো কলকাতার মানুষকে আগুনের হাত থেকে বাঁচাত। নাবিকরা ছিল বেশ আমুদে প্রকৃতির। হরদম মদ খেত। দেশীয়দের ঘরবাড়ি আগুন থেকে রক্ষা করতে তাদের জুড়ি ছিল না। কারণ, আগুন নেভানোর বিনিময়ে তারা পয়সা পেত।
আগুন নেভাত ভিস্তিরাও। তখন জলের কল হয়নি। বাড়ি বাড়ি পাতকুয়ো আর পুকুর ছিল। চিতপুর রোড, ওরিয়েন্টাল সেমিনারির উত্তর দিকে ইট দিয়ে লহর গাঁথা ছিল। চাঁদপাল ঘাট থেকে পাম্প করে জল ওই লহরের ভেতর দিয়ে গরানহাটা পর্যন্ত এসে পৌঁছত। সেই জল আগুন নেভাবার কাজে লাগত। দমকল আবিষ্কারের পর তাদের সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হত গরুর গাড়িতে। পরে গরুর জায়গায় চলে আসে ঘোড়া।
আগুন প্রতিরোধের জন্য ১৮৩৭-এ প্রথম আইন করা হয়। ‘এই আইন দ্বারা স্থির হয় যে অদাহ্য পদার্থ দ্বারা গৃহের ছাদ বা আচ্ছাদনকে আবৃত রাখতে হইবে। ফলে খড়ে ছাওয়া বাড়ি যা অগ্নিকাণ্ডের কারণ হইতে পারে এই রূপ আচ্ছাদন যুক্ত গৃহ কলিকাতায় অতীতের বস্তু হইয়া যায়।’

তথ্য-কৃতজ্ঞতা: হরিপদ ভৌমিক


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.