তিনি সময়ে যথার্থ সিদ্ধান্ত লইয়াছেন, তাঁহার প্রধানমন্ত্রিত্বের দ্বিতীয় দফায় মনমোহন সিংহ সম্বন্ধে এই কথাটি তাঁহার প্রবলতম হিতৈষীও বলিবেন না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিনি সিদ্ধান্তহীন থাকিয়াছেন। যে কয়টি ক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত তিনি সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন, তাহাতেও তাঁহার বিলম্ব রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে মারাত্মক হইয়াছে। তবুও, সিদ্ধান্তহীনতা অপেক্ষা দীর্ঘসূত্রী সিদ্ধান্ত ভাল। দেরিতে হইলেও তাহাতে কাজের কাজ হয়। যেমন, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট কাউন্সিলে মুখ্যমন্ত্রীদের উদ্দেশে তাঁহার ভাষণে প্রধানমন্ত্রী বলিলেন, আগামী দশ মাসে ডিজেলের দাম লিটার প্রতি ১০ টাকা বাড়াইবার পরিকল্পনা আছে তাঁহার। কিন্তু একবারে নহে, প্রতি মাসে এক টাকা করিয়া দাম বাড়িবে। ডিজেলের দাম না বাড়িলে রাজকোষ ঘাটতির পরিমাণ নিয়ন্ত্রণ করা অসম্ভব। আবার, রাজকোষ ঘাটতির হার সরকারের প্রতিশ্রুত পথে না ফিরিলে পরিচিত সমস্ত সমস্যার সূত্রপাতের সহিত ভারতের ক্রেডিট রেটিংও কমিবে, ফলে বিনিয়োগ পাইতে সমস্যা হইবে। অতএব, ডিজেলের দাম, বহু বিলম্বে হইলেও, বাড়িবে। অবশ্য কবে, তাহা জানা যায় নাই। প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পরেই যোজনা কমিশন জানাইয়া দিয়াছে, রাজনৈতিক ঐকমত্য না হওয়া পর্যন্ত সরকার এই পথে হাঁটিবে না। ‘রাজনৈতিক ঐকমত্য’ নামক সোনার পাথরবাটির প্রতীক্ষায় কত দিন বসিয়া থাকিতে হইবে, তাহা কেহ জানিলে তাঁহার নোবেল পুরস্কার বাঁধা।
দীর্ঘমেয়াদে যে কৃত্রিম ভাবে ডিজেলের দাম চাপিয়া রাখা যাইবে না, এই কথাটি সাধারণ জ্ঞানের পর্যায়ভুক্ত। আজ অথবা কাল, দাম বাড়াইতেই হইবে। এত কাল এক প্রকার নিয়ম ছিল, নেতারা যত দিন সম্ভব, দাম চাপিয়া রাখিবেন আর শেষে নাভিশ্বাস উঠিলে এক ধাক্কায় অনেকখানি দাম বাড়াইয়া প্রবল জনরোষ তৈরি করিবেন। এই প্রথাটি ভাঙিবার উপযুক্ততম পাত্র অবশ্যই মনমোহন সিংহ তাঁহার ন্যায় প্রাজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ভারতীয় রাজনীতি আর দেখে নাই। তাঁহারও এই পথটি খুঁজিয়া পাইতে এত দেরি কেন হইল, সে এক রহস্য। কিন্তু, পথটি যখন পাওয়াই গিয়াছে, তাহাতে বহু দূর হাঁটা প্রয়োজন। জিনিসের দাম বাড়িলে মানুষ তেমন ক্ষুব্ধ হন না নচেৎ সব বাজারে আক্ষরিক অর্থেই আগুন জ্বলিত। আচমকা অনেকখানি বাড়তি খরচের বোঝা কাঁধে আসিয়া পড়িলে তাঁহারা বিরক্ত হন, রাগিয়া যান। মানুষ খুব ভাল ভাবে বোঝেন, পরিকাঠামো টিকাইয়া রাখিতে হইলে দাম বাড়াইতেই হইবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী এত দিনে যে পথটি খুঁজিয়া পাইয়াছেন, সেই পথে। রাজনীতিকরা এই সত্যটি এড়াইয়া সস্তায় জনপ্রিয়তা অর্জনের বিপজ্জনক খেলায় মাতেন। তাহাতে সাধারণ মানুষের লাভ হয় না। পরিকাঠামোর অবনতি ঘটিলে, প্রয়োজনের পণ্য পাওয়া না গেলে তাহাদের দুর্ভোগ বাড়ে বই কমে না। তাঁহারা বুঝিতেও পারেন, রাজনীতিকরা তাঁহাদের মুখ চাহিয়া দাম না বাড়াইবার জেহাদে নামেন নাই, নেতাদের পাখির চোখ শুধুমাত্র ব্যালট বাক্স। তবু, এই লুকাচুরি খেলার অসহায় সাক্ষী থাকা ভিন্ন তাঁহাদের আর কিছু করিবার নাই।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ যেমন গত বৎসর সাক্ষী থাকিলেন। এই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী অধুনা তাঁহার জেদের জন্য বিশেষ খ্যাতি পাইয়াছেন। গত বৎসর তিনি জেদ ধরিয়াছিলেন, বাসের ভাড়া বাড়াইবেন না। এ দিকে, ডিজেলের দাম বাড়ায়, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের মূল্যবৃদ্ধিতে বাসমালিকদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ভাড়া না বাড়ায় একের পর এক বাস বসিয়া গেল। রাস্তা ফাঁকা, মানুষ নাজেহাল। অনেক বেশি পয়সা কবুল করিয়া অটো রিকশা আর শেয়ার ট্যাক্সিতে চড়িতে হইল। মুখ্যমন্ত্রী যদি জেদ ছাড়িয়া ধাপে ধাপে বাসভাড়া বাড়াইয়া তাহাকে বাস্তবোপযোগী রাখিতেন, মানুষ অনেক স্বস্তিতে থাকিত। কিন্তু না, তিনি শেষ পর্যন্ত সামান্য ভাড়া বাড়াইয়া ভবিষ্যতে আরও বহু দফা অশান্তির পথ খুলিয়া রাখিলেন। অবশ্য, ভাড়া বাড়ানোয় তাঁহার চিরকালই অনীহা। রেলে যাত্রী-ভাড়া বাড়ানোয় তিনি এমনই রুষ্ট হইয়াছিলেন যে দীনেশ ত্রিবেদীর চাকুরিটিই গেল। ফলে, প্রধানমন্ত্রীর দেখানো পথে তিনি কয় পা হাঁটিবেন, সেই প্রশ্ন থাকিয়াই গেল। |