|
|
|
|
বছর শেষেও স্পষ্ট, লড়াই চলবে |
লক্ষ্য তাঁরাই, দিল্লির নেতাহীন আন্দোলন বোঝাল নেতাদের |
নিজস্ব সংবাদদাতা • নয়াদিল্লি |
কেটে গেল আরও একটি বছর।
বছরভরের যাবতীয় স্মৃতি ফিকে করে উজ্জ্বল হয়ে রইল একটি নাম।
দামিনী।
দিল্লির এই সাহসী তরুণীর মৃত্যুর পরে যে ভাবে গোটা দেশ উত্তাল হয়ে উঠেছে মেয়েদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে, তা এ দেশের নাগরিক-আন্দোলনের ইতিহাসে এক কথায় নজিরবিহীন। বর্ষবরণের সন্ধ্যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তের আলোকসজ্জাও ম্লান হয়ে গিয়েছে মোমবাতির আলোর নীরব প্রতিবাদে। স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে, আন্দোলনের এই স্বরকে সহজে চুপ করানো যাবে না।
কিন্তু এত কিছুর পরেও কি এতটুকুও কমেছে মেয়েদের উপর অত্যাচার? হরিয়ানা, গুজরাত থেকে পশ্চিমবঙ্গ প্রতিদিনই মহিলাদের উপর অত্যাচারের নতুন নতুন ঘটনা সামনে আসছে। স্বাভাবিক ভাবেই তাই যন্তর-মন্তরে এ দিন বছর শেষের প্রতিবাদ মিছিল প্রশ্ন তুলছে, দামিনীর বলিদানেও কি বদলাবে না কিছু? তাই আর চুপ করে থাকতে চান না প্রতিবাদীরা। বছরের শেষ দিনেও দিল্লির প্রাণকেন্দ্র কনট প্লেসে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন তাঁরা। মুনিরকা বাসস্ট্যান্ড, সিনেমা দেখে ফেরার পথে যেখান থেকে বন্ধুর সঙ্গে শেষ বার বাসে উঠেছিলেন দামিনী, সেখানে প্রতিবাদ মিছিল করেই বর্ষবরণ করল দিল্লির নতুন প্রজন্ম। দামিনীর মৃত্যুর জন্য দায়ী অপরাধীদের সাজার দাবিতে দু’জন অনশনেও বসেছেন যন্তর-মন্তরে। পিছিয়ে নেই সার্চ ইঞ্জিন গুগল-ও। দিল্লির সাহসী তরুণীকে শ্রদ্ধা জানিয়ে নিজেদের হোমপেজে একটি জ্বলন্ত মোমবাতির ছবি দিয়েছে তারা।
আর এই সম্মিলিত প্রতিবাদের ধাক্কায় নড়ে বসতে বাধ্য হয়েছে সরকার। দামিনীর ধর্ষণ ও মৃত্যুতে দোষীদের শাস্তি দিতে অস্বাভাবিক দ্রুততায় তৈরি হয়ে গিয়েছে হাজার পাতার খসড়া চার্জশিট। তিরিশ জন সাক্ষীও তৈরি। |
নতুন কী
|
নতুন বছরে কী হবে পরিবর্তন? প্রশ্ন রাজধানীর পথের প্ল্যাকার্ডে। ছবি: পিটিআই।
|
ইতিমধ্যেই দুই অভিযুক্তের শনাক্ত প্যারেড হয়েছে। দামিনীর পরিবারকে ১৫ লক্ষ টাকা ও পরিবারের একজনকে চাকরির প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে দিল্লি সরকার। উত্তরপ্রদেশ সরকার তরুণীর পরিবারকে ২০ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে। এর পাশাপাশি ধর্ষণের শাস্তি কী হওয়া উচিত, তা জানতে চেয়ে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দে চিঠি লিখেছেন সব রাজনৈতিক দলকে। ধর্ষণের শাস্তির বিধান তৈরির জন্য গঠিত বর্মা কমিটির কাছে সব পক্ষকে মতামত জানাতে বলেছেন। সেই রিপোর্ট এলেই বসবে সর্বদল বৈঠক। সংসদের বিশেষ অধিবেশন বসতে পারে, সরকারের তরফে এমন ইঙ্গিতও মিলেছে। নতুন বছর থেকেই মহিলাদের জন্য বিশেষ হেল্পলাইন খুলতে তৎপর হয়েছেন শীলা দীক্ষিত। কিন্তু সেই হেল্পলাইন অকেজো হয়েছে প্রথম দিনেই।
তাই থামতে চান না আন্দোলনকারীরা। অপরাধীদের শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত পথকেই ঠিকানা করে অতন্দ্র প্রহরীর মতো জেগে থাকতে চান তাঁরা। যে দিন চার্জশিট দেওয়া হবে, সে দিনটিকে ‘কালা দিবস’ হিসেবে পালন করতে চান তাঁরা। বছর শেষ হয়েও নতুন বছরের আমেজে আন্দোলন যাতে স্তিমিত না হয়, সে জন্য সতর্ক থাকতে চান প্রতিবাদীরা।
প্রতিবাদীদের এই দৃঢ়তা, এই স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন তাই স্বাভাবিক ভাবেই শাসক দলের কপালে ভাঁজ ফেলছে। চিন্তিত অন্যরাও। নেতাহীন এই আন্দোলন যে আসলে নেতাদের বিরুদ্ধেই, তা বিলক্ষণ বুঝতে পারছেন সব পক্ষ। যে কারণে দামিনী যখন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তখন আন্দোলনকারীদের ক্ষোভকে প্রশমিত করতে মাঝরাতে দশ জনপথের বাইরে এসে ফুটপাথে বসে তাঁদের কথা শুনে অনন্য নজির গড়েছিলেন সনিয়া গাঁধী। মেয়েটির মৃত্যুর পরেও জানিয়েছেন, তাঁর এই বলিদান বৃথা যাবে না। প্রতিবাদের ভাষা সরকার বুঝতে পেরেছে। দামিনীর মৃত্যুতে ব্যথিত সনিয়া বর্ষবরণের উৎসব পালন থেকে সকলকে বিরত থাকতে আহ্বান জানিয়েছেন। দলীয় কর্মী-নেতাদের জানিয়ে দিয়েছেন, কেউ যেন তাঁকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা না জানান। রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ও এ বছর বর্ষকরণের উৎসব পালন করবেন না বলে জানিয়েছেন। রেল এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীও পালন করবে না নতুন বছরের উৎসব।
তবু উদ্বেগ যাচ্ছে কই? কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতার কথায়, “মেয়েটির ধর্ষণ ও মৃত্যুর ঘটনা ঘিরে এই নেতাহীন আন্দোলন স্পষ্ট করে দিয়েছে, সংসদীয় ব্যবস্থা থেকে মানুষের বিচ্ছিন্নতা কতটা। রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে এই আন্দোলন।” একই সঙ্গে তিনি বলেন, “ওই মেয়েটি মুখহীন। ওঁকে কেউ দেখেননি, কেউ চেনেন না। কিন্তু তাঁর জন্য যে ক্ষোভটি প্রকাশ পাচ্ছে, তা রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিরুদ্ধেই। আর যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, স্বাভাবিক ভাবেই সেই ক্ষোভ আছড়ে পড়ে তাদের বিরুদ্ধে।”
বিজেপি নেতৃত্বও বুঝছেন তিরটা আসলে কোন দিকে। ঘরোয়া স্তরে লালকৃষ্ণ আডবাণীরাও মানছেন, গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থারই বহিঃপ্রকাশ ঘটছে দামিনীকে ঘিরে গড়ে ওঠা এই আন্দোলনে। আর যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তখন তাদেরই সামলাতে হয় এই আঘাত। বিরোধী দলে থাকার সুবাদে মানুষের এই স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষোভ যাতে কংগ্রেসের বিরুদ্ধেই যায়, তার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন তাঁরা। তার জন্য যে যন্তর-মন্তর শীলা দীক্ষিতকে ধিক্কার জানিয়ে ফেরত পাঠিয়েছে, সেখানে গিয়েই বিজেপি নেতারা স্মরণসভা করছেন। দলের দফতরেও শোকসভার আয়োজন করছেন সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলিরা। সেখানে সুষমা বলেন, “ধর্ষণের অপরাধীদের যদি আদালত মৃত্যুদণ্ড দেয়, তার জন্য প্রাণভিক্ষার আবেদন বিবেচনা করার কোনও অর্থ নেই। সোজা ফাঁসি কাঠে ঝুলিয়ে দেওয়া উচিত তাদের। কঠোর আইন হলেই এ ধরনের ঘৃণ্য অপরাধ করার সময় ভয় আসবে।” |
|
|
|
|
|