দুই রাজ্য। দুই চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গ ও গুজরাত। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও নরেন্দ্র মোদী। দুই মুখ্যমন্ত্রীই লগ্নি টানার কথা বলেন। তার জন্য শিল্প-সম্মেলন করেন। নতুন বছরে শিল্পপতিদের সঙ্গে বৈঠকে বসতে চলেছেন দু’জনেই। জানুয়ারি মাসেই হলদিয়ায় ‘বেঙ্গল লিডস’ আর গাঁধীনগরে ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত-গ্লোবাল সামিট’। মিল এটুকুই। ফারাক অনেক।
‘বেঙ্গল লিডস’-এর কথা শুনে আগ্রহভরে খোঁজখবর শুরু করেছিলেন দিল্লির এক শিল্পপতি। কিন্তু কোথায় খোঁজ মিলবে? ‘বেঙ্গল লিডস’-এর একটি সরকারি ওয়েবসাইট আছে। কিন্তু সোমবার রাত পর্যন্ত তাতে গত জানুয়ারিতে কলকাতার মিলন মেলায় অনুষ্ঠিত শিল্প-সম্মেলনের বিস্তৃত বর্ণনা। আসন্ন সম্মেলনের নামগন্ধ নেই। “আর ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর ওয়েবসাইট দেখুন। এক ক্লিকেই সব তথ্য হাজির।” বললেন ওই শিল্পপতি। |
ওয়েবসাইটে এখনও ২০১২-তেই পড়ে বেঙ্গল লিডস। |
বাস্তবিকই তাই। ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’ শুরু হচ্ছে ১১ জানুয়ারি। চলবে ১৩ তারিখ পর্যন্ত। কোন দিন, কখন, কী বিষয়ে আলোচনা, কে বক্তা, কোথায় কী প্রদর্শনী, সব তথ্য বহু আগে থেকেই ওয়েবসাইটে হাজির। ওই সময় গাঁধীনগর যেতে চাইলে কী ভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন, সরকারের থেকে কী কী সুবিধা মিলবে, তা-ও বলা আছে। রতন টাটা, মুকেশ অম্বানী, অনিল অম্বানী থেকে শুরু করে দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা মোদীর পাশে একই মঞ্চে হাজির থাকবেন। আমেরিকা, ব্রিটেন, চিন, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, বাহরিন, বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড কোনও দেশই বাদ থাকছে না। ইউএস-ইন্ডিয়া বিজনেস কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট রন সমার্স বলছেন, “কানাডা ও জাপান আগেই গুজরাতের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছে। এ বার আমেরিকাও পার্টনার কান্ট্রি হবে, এটাই আমার লক্ষ্য।” ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর দু’দিন পরেই, ১৫ জানুয়ারি থেকে হলদিয়ায় শুরু হবে ‘বেঙ্গল লিড্স’। কিন্তু মহাকরণের বাইরে বসে তার সম্পর্কে কোনও তথ্য জোগাড় করা মুশকিল। শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, টাটা গোষ্ঠীর নতুন কর্ণধার সাইরাস মিস্ত্রিকে এই সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। যদিও টাটা গোষ্ঠীর সূত্রের বক্তব্য, এখনও কোনও আমন্ত্রণ আসেনি। পার্থবাবুর বক্তব্য, গত বার যাঁদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল, তাঁদের পাশাপাশি আরও কয়েক জন শিল্পপতিকে বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে। কিন্তু কলকাতার কিছু পরিচিত মুখ বাদ দিলে দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা ক’জন হলদিয়া যাচ্ছেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
শুধু আমন্ত্রিতের তালিকা নয়, শিল্পনীতি নিয়েও মমতার থেকে বহু কদম এগিয়ে মোদী। ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর ওয়েবসাইটে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ভারী শিল্প, শিক্ষা, পরিষেবা, বন্দর-জাহাজ, কৃষি বিপণন ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, পরিকাঠামো এবং অপ্রচলিত শক্তির মতো ক্ষেত্রে বিনিয়োগের উপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। রাজ্যে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, বিশেষ বিনিয়োগ অঞ্চল এবং দিল্লি-মুম্বই ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল করিডরকে কেন্দ্র করে কোথায় কোথায় বিনিয়োগের সুযোগ রয়েছে, ওয়েবসাইটে দেখলে স্কুল-ছাত্রও তা বুঝে ফেলতে পারবে। সরকারি সূত্রের খবর, এ বারের সম্মেলনে নতুন তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ নীতি ঘোষণা করতে চলেছেন মোদী।
অন্য দিকে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার এখনও ইনফোসিস-কে এসইজেড তকমা না-দেওয়ার অবস্থানে অনড়। শিল্পের জন্য জমিনীতি বা জমির ঊর্ধ্বসীমা শিথিল করার ব্যাপারেও যে হলদিয়ায় মমতা নতুন কোনও আশার কথা শোনাবেন, এমনটা জোর দিয়ে বলতে পারছেন না কেউ। মমতা শিল্পের জন্য সরকারি উদ্যোগে জমি অধিগ্রহণের ঘোর বিরোধী হলেও দিল্লিতে নিযুক্ত গুজরাতের এক আমলা বলেন, “গত অর্থবর্ষে গুজরাত শিল্পোন্নয়ন নিগম প্রায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমি অধিগ্রহণ করেছে। ডেডিকেটেড ফ্রেট করিডরের ৩৮% গুজরাতের মধ্যে দিয়ে যাবে। কাজেই লগ্নির জন্য জায়গার অভাব নেই।”
মমতা যখন নিজের রাজ্যে শিল্প আনতেই হিমসিম খাচ্ছেন, তখন ‘ভাইব্র্যান্ট গুজরাত’-এর সুবিধা অন্য রাজ্যেও পৌঁছে দিতে চাইছেন মোদী। গুজরাতের মঞ্চকে কাজে লাগিয়ে বিদেশি শিল্পপতিদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে চাইছে ২১টি রাজ্য। তাদের মধ্যে কর্নাটক, ছত্তীসগঢ়, মধ্যপ্রদেশের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্য যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে দিল্লি, মহারাষ্ট্রের মতো কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যও।
গুজরাত যে শিল্পায়নের পথে অনেক এগিয়ে গিয়েছে, সে কথা স্বীকার করছেন তৃণমূল নেতারাও। সম্প্রতি দিল্লি এসে মমতাও সে কথা বলেছেন। এই এগিয়ে থাকার কারণ হিসেবে তৃণমূল নেতাদের যুক্তি একটাই গুজরাতকে পশ্চিমবঙ্গের মতো বাম-আমলের বোঝা বইতে হচ্ছে না। কিন্তু রাজ্য সরকারের তৎপরতা যে গত দেড় বছরেও বাড়েনি তা হাতেগরম প্রমাণ ‘বেঙ্গল লিডস’-এর ওয়েবসাইট। ‘খুব শীঘ্রই’ অবশ্য এ বিষয়ে পদক্ষেপ করার আশ্বাস দিয়েছেন রাজ্যের শিল্প দফতরের এক কর্তা। |