মোটরবাইকে চড়ে আসা দুষ্কৃতীদের হাতে বাড়ির কাছেই খুন হয়ে গেলেন দুই যুবক। সোমবার সকালে লাউদোহার আমদহি গ্রামে কয়লা কারবার নিয়ে গোষ্ঠী রেষারেষির জেরেই এমন ঘটেছে বলে প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের অনুমান। যদিও তৃণমূলের দাবি, এক যুবক তাঁদের দলের কর্মী ছিলেন। সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাঁকে খুন করেছে বলে অভিযোগ। সিপিএম অবশ্য এই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে। এলাকার গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরেই এমন ঘটেছে বলে দাবি সিপিএমেরও।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, এ দিন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ বাড়ি থেকে বাইরে বেরোচ্ছিলেন সৈয়দ আহমেদ ওরফে শেখ লালু (৩৫)। তখন মোটরবাইকে চড়ে আসা কয়েক জন দুষ্কৃতী তাঁকে গুলি করে। মাথায় ও বুকে তিনটি গুলি লেগে লুটিয়ে পড়েন তিনি। কিছু ক্ষণের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একই রকম ঘটনা ঘটে গ্রামের অন্য দিকে। পুলিশ জানায়, স্ত্রীর সঙ্গে ধান ঝাড়াইয়ের কাজ করছিলেন মনসুর আলি ওরফে শেখ মন্টু (৩৬)। তাঁর স্ত্রী তহমিনা বিবি অভিযোগ করেন, মোটরবাইকে চড়ে ১০-১২ জনের একটি দল এসে প্রথমে মন্টুর ভাই আলি হাসান ওরফে শেখ ধনেশ্বরের খোঁজ করে। তিনি বাড়িতে নেই জানানোয় এক দুষ্কৃতী মন্টুকে লক্ষ করে গুলি করে। তাঁর কাঁধ ও পাঁজরে গুলি লাগে। দুর্গাপুর মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
তহমিনা বিবির দাবি, দুষ্কৃতীদের মধ্যে অন্তত চার জনকে তাঁরা চিনতে পেরেছেন। তারা কৈলাসপুরের বাসিন্দা জিয়াউল, সফিকুল, জাকির ও নুরুল। মন্টুর মা জুলেখা বিবি এই চার জনের পাশাপাশি কয়েক জন অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীর নামে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ জানায়, প্রথম দু’জন কয়লা মাফিয়া শেখ সেলিম খুনে অভিযুক্ত। এ দিন শেখ মন্টুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরে সেখানে যান এডিসিপি (পূর্ব) সুনীল যাদব। মৃত্যুর আগে শেখ মন্টু তাঁর সঙ্গে কথাও বলেন। এডিসিপি বলেন, “তদন্ত শুরু হয়েছে। দ্রুত ঘটনায় জড়িতদের ধরে ফেলা হবে।” |
এ দিনের জোড়া খুনের পিছনে অবৈধ কয়লা কারবারের যোগ রয়েছে বলেই মনে করছে পুলিশ। দীর্ঘদিন ধরে এই তল্লাটে কয়লা কারবারে নেতৃত্ব দিয়েছেন শেখ সেলিম। পরে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে উত্থান হয় শেখ আমিনের। এলাকায় কর্তৃত্ব দখল নিয়ে মাঝে-মধ্যেই গুলি-বোমার লড়াই শুরু হয়। দুষ্কৃতীরা তখন প্রকাশ্যে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি শুরু করে। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এ সবের সঙ্গে সেই সময়ে জড়িয়ে পড়ে তৎকালীন শাসক দলের একাংশও। এর মধ্যেই কয়লা পাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নামেন সিপিএমের লাউদোহা লোকাল কমিটির সদস্য শেখ ফারুখ হোসেন-সহ কয়েক জন। ২০০৮-এর ২৩ জুলাই কেন্দোলা মোড়ে খুন হন সিপিএম নেতা শেখ ফারুখ হোসেন ও তাঁর সহকারী সুধীর বাউড়ি। ঘটনায় মূল অভিযুক্ত ছিলেন সেলিম। ধরা পড়ে দীর্ঘদিন জেল খাটেন তিনি। তবে জামিনে ছাড়া পাওয়ার পরে সেলিম নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছিলেন বলে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে খবর। গত ২৫ অক্টোবর বাড়ির কাছেই গুলিতে খুন হয়ে যান তিনি।
এরই মাঝে ২০১১-এর ফেব্রুয়ারিতে দুই তৃণমূল কর্মী শেখ খোকন ও শেখ কামাল খুনে শেখ আমিন ও তার এক শাগরেদকে মাধাইগঞ্জ গ্রেফতার করে পুলিশ। এই ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত এ দিন নিহত শেখ লালু। শেখ আমিন এখনও জেলে। ফলে, এলাকায় শান্তি ফিরেছিল বলে পুলিশের দাবি। কিন্তু সেলিম খুন হতেই পরিস্থিতি পাল্টেছে বলে জানান পুলিশের এক আধিকারিক। তিনি জানান, দুর্জয় বিশ্বাস নামে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার সহযোগিতায় শেখ আমিনের কয়েক জন অনুগামী সেলিমকে খুন করে বলে অভিযোগ। ওই পুলিশকর্তার অনুমান, ওই ঘটনার বদলা নিতেই এ দিন সেলিমের ঘনিষ্ঠ কয়েক জন আমিনের অনুগামী লালুকে খুনের পরিকল্পনা করে। তারা মন্টুর ভাই ধনেশ্বরকে ব্যবহার করে। এ দিকে, শেখ লালুকে খুনের খবর পেয়েই কয়েক জন ধনেশ্বরের বাড়িতে চড়াও হয়। তাঁকে না পেয়ে মন্টুকেই গুলি করে তারা।
তৃণমূলের ব্লক সভাপতি সুজিত মুখোপাধ্যায় বলেন, “শেখ মন্টু সক্রিয় তৃণমূল কর্মী হিসেবে পরিচিত। এলাকায় সন্ত্রাস ছড়াতে সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীরা তাঁকে খুন করেছে।” সিপিএম অবশ্য ঘটনার সঙ্গে রাজনীতির কোনও যোগ নেই বলে দাবি করেছে। পাণ্ডবেশ্বরের সিপিএম বিধায়ক গৌরাঙ্গ চট্টোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “ওই এলাকায় গোষ্ঠী সংঘর্ষ লেগেই রয়েছে। যা খবর পেয়েছি, এ দিনও তেমনই ঘটেছে।” আসানসোল-দুর্গাপুরের পুলিশ কমিশনার অজয় নন্দও জানান, গোষ্ঠী-রেষারেষির কারণেই এমন ঘটনা বলে প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গ্রামে পুলিশি টহল রয়েছে। |