বঞ্চনার বছর
দড়ি ধরে মারো টান, টোনি হবে না খান খান

দড়ি ধরে মারো টান, টোনি হবে খান খান। ২০১২ সালে তো এটাই অনেকের উদ্দেশ্য ছিল...

আরে! দড়ি ধরে টান মারার থেকে ‘টাগ অব ওয়ার’ খেলব আমি। একবার স্কুলে থাকতে ‘টাগ অব ওয়ার’-এ নামি। যখন দেখি হেরে যাচ্ছি, তখন দড়িটা ছেড়ে দিই। অমনি উল্টো দিকের চারজন কুপোকাত।

বাহহহহ! এটা তো বেশ সেয়ানা বুদ্ধি!
আরে সেয়ানা যদি হতাম, তাহলে আমি টোনি থাকতাম না কি?

অনেকে বলেন আপনার স্ত্রী ইন্দ্রাণী আপনার আসল বুদ্ধিদাতা?
দেখুন, ইন্দ্রাণী আর আমার মধ্যে দারুণ আন্ডারস্ট্যান্ডিং। সিনেমাতে আমি কী করব না করব তার পুরো স্বাধীনতা আমার আছে।

এটা কি ঠিক, আপনি ছবি বানান জাতীয় পুরস্কার পাবেন ভেবে?
যখন ‘অনুরণন’ বানাই, তখন আমি ‘অরবিন্দন’ পুরস্কার পাই। জুরি চেয়ারম্যান বালু মহেন্দ্রু বলেন যে আমি আরও বাঁচতে চাই তোমার কাজ দেখব বলে। তবে আমার ধারণা ছিল জাতীয় পুরস্কার একমাত্র ইস্যু-ভিত্তিক ছবির জন্য দেওয়া হয়। আমার ছবিতে তো গান ছিল। ভাবিনি যে জাতীয় পুরস্কার পাবে! ‘অন্তহীন’ যখন বানাই তখন তো মজা করতে করতেই ছবি হয়ে যায়। ছবি বানানোর আগে একটি মেয়ের সঙ্গে আমার ই-মেলে কথা হত। লন্ডনে একবার বেড়াতে গিয়ে ও আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করল, “হু উইল ব্রেক দ্য আইস?” আমরা দেখা করলাম। আমি মেয়েটিকে বোঝালাম যে আমি বিবাহিত। কিন্তু আমি বন্ধুত্ব রাখতে রাজি। আমার মেয়ে ও ইন্দ্রাণী সব ই জানত। এই ঘটনাটা কেন্দ্র করেই তো ‘অন্তহীন’ বানানো। কাস্ট করলাম রাধিকা আপ্তে-কে। শুধুমাত্র ওকে একটা রেস্টুরেন্টে অদ্ভুত ভাবে চাউমিন খেতে দেখে। ‘অপরাজিতা তুমি’ বানানোর আগে ‘কুট্টি শ্রাঙ্ক’ দেখেছিলাম। পদ্মপ্রিয়াকে ওই ছবিতে দেখে খুব ভাল লেগেছিল। ও যে বছর জাতীয় পুরস্কার পায়, আমি রিজিওনাল ফিল্মের জুরিতে ছিলাম। জাতীয় পুরস্কার বিতরণের দিন আমি ওকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আমার ছবিটা করবে কি না। ও বলে আমাকে স্ক্রিপ্ট-টা পাঠাতে।

একজন জুরি হয়ে জাতীয় পুরস্কার অনুষ্ঠানেই একজন অভিনেত্রীকে বললেন অভিনয় করতে? ওটাই তো নিজের ঝুলিতে পুরস্কার আনার চেষ্টা...
প্ল্যান যদি করেই থাকি, তা হলে তো সেটায় সফল হলাম না। ‘অপরাজিতা তুমি’ তো জাতীয় পুরস্কার পায়নি।
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল
হিসেব-টা হয়ত ঠিক হয়নি। ছোটবেলায় অঙ্কে কত পেতেন?
অঙ্কে কোনও দিন ভাল ছিলাম না। পাশ করে যেতাম। ওই রকম অঙ্ক করলে তো প্রত্যেক জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেতাকে নেওয়া মানেই মনে হবে কোনও ফন্দি আঁটছেন ডিরেক্টর। আমি ছবি করি নিজের ইচ্ছেতে। বিশ্বাস করি যে আমার সেই স্বাধীনতাটা যেন থাকে যাতে আমি নিজে ঠিক করতে পারব কার সঙ্গে কাজ করব আর কার সঙ্গে কাজ করব না। কিন্তু ধার করা ভিশন নিয়ে আমি ছবি করতে পারব না। আমি যখন ঠিক করে নিই তখন একটা ছবির পেছনে নিজের ১০০ শতাংশ দিই।

তবে যে বলা হয় টোনি অপর্ণা সেনের মতন করে ছবি বানাতে চান...
রিনাদি আমার অনুপ্রেরণা। ওঁর মতো করে আমি কেন ছবি বানাব? লোকে শুধুমাত্র আমার ছবির এই লাইফটা দেখে। তার পেছনের স্ট্রাগলটা দেখে না। কেউ কি জানে যে ‘অনুরণন’ বানাবার সময় আমার ২২ লক্ষ টাকা লোকসান হয়? যে লোকটার আমাদের লন্ডনের প্রোডাকশনটা দেখাশোনা করার কথা, সে আগের দিন রাতে আমাদের জানায় যেন আমরা লন্ডনে না যাই। তবু ঋতুপর্ণা আর রাহুল বলেছিল আমরা ছবিটা শেষ করবই। শুধু আমি সুখী পরিচালক বললেই চলবে?

আপনি যে পরিবেশে ছোটবেলা থেকে মানুষ সেটা কিন্তু আপনার ছবিতে পাওয়া যায় না। একটা অ্যাকোয়ার্ড টেস্টের ছবি বানান...
আমি যে পরিবেশে আজকে থাকি, সেটা তো আমার কাছে আরও বেশি পরিচিত। আমি বাড়িতে ওয়াইন খাই। দুপুরে লটে মাছ দিয়ে ভাতও খাই। হঠাৎ কেন যে বলা হয় আমার সব কিছুই অ্যাকোয়ার্ড, সেটা বুঝি না।

আজ আপনি বলেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আড্ডা দেন। রিনাদি আপনার বাড়িতে ডিনার করেন। তো ছোটবেলাতে তো এই সব ছিল না...
ছিল না তো। আমার সঙ্গে এদের যদি দেরিতে পরিচয় হয়ে থাকে তার মানে তো এই নয় যে সারাজীবন এদের সঙ্গে মেলামেশা করব না? আমার ছোটবেলাটা ভীষণ ভায়োলেন্ট। আমি আর আমার মাসি দেখেছি ঠেলা করে লাশ নিয়ে যেতে। বাবার সামনে রিভলভার ধরতে দেখেছি। নিজে খাটা পায়খানাতে গেছি। থার্ড ক্লাস কামরায় চেপে বিহার থেকে কলকাতা যাতায়াত করেছি।

এই সব ছবি কোথায় আপনার সিনেমাতে?

দেখুন মাত্র তিনটে ছবি করেছি। নিশ্চয়ই দেখবেন সেটা। তবে সময় দিন।

খুব তাড়াতাড়ি আপনার ওপর ‘গ্রেটনেস’-এর তকমাটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল বলেই কি আজ তার ফল ভোগ করছেন?
মিথ্যে বলব না। আমার ছবি অথবা ইন্টারভিউ বেরোলে নিশ্চয়ই ভাল লেগেছে। তবে এখন যা হচ্ছে তা দেখে মন খারাপ হয়।

মনোকষ্টের কারণ?
মনে পড়ে সুনীলদার সেই লাইন: ‘মন ভাল নেই’। একটা ধারণা তৈরি করা হচ্ছে যে আমি ফ্লপ। ঠিকঠাক হিসেব করলে দেখা যাবে এ বছর ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ আর ‘হেমলক সোসাইটি’ ছাড়া সেভাবে কোনও প্যারালল ছবি ব্যবসা করেনি। একটা অদ্ভুত ঔদ্ধত্য দেখি। একটা ছবি বানানোর পরেই পরিচালক বলতে শুরু করেন এর এই ছবি করা উচিত, ওটা করা উচিত না।

টোনির ছবি তো একটা বড় বিজ্ঞাপন বা ভাল মিউজিক ভিডিও। এটা শুনেছেন?
আই লাভ ইমেজেস। সেটাতে জোর দিতে ভাল লাগে আমার। আর গান তো আমাদের কালচারেই আছে। সেটা তো ছবিতেও আসবে। সমালোচনা আমি নিতে পারি। তবে বোঝা যায় কে কোন উদ্দেশ্য নিয়ে সমালোচনা করছে। শুধু সমালোচনা করে, চমক দিয়ে কি একটা টিকিট-ও বেশি বিক্রি হয়? হয় না। আমি তো বাড়িতে বসে লিওনার্দো কোহেন, প্যাটবুল আর বব ডিলান শুনি। তাই বলে কি আমি বলব যে কে কোন গানটা কোথা থেকে টুকেছে? আমার ছবিতে ওরিজিনাল গান থাকে। আমি খাটি সেটার জন্য। অনেকে বলে আজকাল তো ভাড়াটের ভাড়াটে টাইপের গান ব্যবহার করা হচ্ছে কিছু ছবিতে। প্রথমে একটা বিদেশি গান থেকে বেসিক গান টোকা হচ্ছে।

পরিচালক গৌরব পাণ্ডের সঙ্গে এখন মনোমালিন্য?
না। বিরক্ত ছিলাম। শুনেছিলাম ও অনেককে বলেছে যে ও না কি ‘অনুরণন’ বকলমে পরিচালনা করেছে। তবে ‘শুকনো লঙ্কা’ দেখে আমার দারুণ লেগেছিল। মেসেজ করেছিলাম। কেউ চড় মারলে আমি মাইন্ড করি না। তবে তঞ্চকতাকে ঘৃণা করি।

হতাশ লাগছে?
ছিলাম হতাশ। তবে রণথম্ভোরে বাঘ দেখে হতাশাটা কেটে গিয়েছে। মনে হয়েছে ওরা অনেক বেশি সভ্য আমাদের থেকে। রাগ হলে সোজা থাবা বের করে মাংস ছিঁড়ে খাবে। কিন্তু পেছন থেকে ছুরি মারবে না। এখানে দেখি এই কালচার শুরু হয়েছে। এই আমার সঙ্গে দেখা করে জড়িয়ে ধরে বলল কী ভাল ছবি! বাড়ির বাইরে গিয়ে বলল ‘মিউজিক ভিডিও’ বানিয়েছে। আরে খারাপ লাগলে আমাকে সামনা-সামনি বলো। রিনাদি তো আমাকে কত কথা বলেন। ভাল। মন্দ। বলেন, “টোনি, আরও গভীরে যেতে হবে।” বুদ্ধদা প্রশংসা করার পরেও বলেছেন, চরিত্রগুলো একটু আনরিয়াল হয়ে যাচ্ছে। গৌতমদা বলেছেন, ‘‘মেকিং-টা ভাল। তবে গল্পের দিক থেকে একটু দুর্বল।” মাঝে একটা সময় এসেছিল যখন আমি কাউকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। মনে হত, ‘কেউ কথা রাখে না। কেউ কথা রাখেনি’। আমি জীবনে ছবি করার জন্য লড়াই করতে রাজি। তবে আমি ছবি বানিয়ে প্রতিযোগিতা করি না। ছবি বানানো আর ‘স্যাক রেস’-এ নামা এক জিনিস নয়।

টোনি কী ছবি বানাচ্ছে সেই সব জল্পনা-কল্পনা নিয়ে যত আর্টিকেল বেরিয়েছে, সেটা নিয়েই তো একটা ছবি হয়ে যায়....
আমি কাউকে বলিনি এই সব লেখো। আমার তিনটে স্ক্রিপ্ট রেডি। এই কথাটাই আমি সবাইকে বলেছি। তা-ও যদি লেখালেখি হয় আমি কী করব? আমি আড্ডাবাজ মানুষ। ভাল গান। ভাল খাওয়াদাওয়া। ভাল মদ। আর ভাল বন্ধু। এই সব আমার পুঁজি। দড়ি ধরে টানাটানি হবে। তবে আমার ডেস্টিনি থেকে কেউ আমাকে সরাতে পারবে না।
মা যখন মারা গেলেন, আমি একটা অনুরোধ করেছিলাম। মায়ের হাতে একটা পলার আংটি ছিল। ওটা আমি দিয়েছিলাম। মা আংটিটা বার বার দেখতেন। চেয়েছিলাম সৎকারের সময় ওই আংটিটা যেন হাতে থাকে। সেটাও দেওয়া হয়নি। আমরা একটা জিনিসও আমাদের সঙ্গে নিয়ে যেতে পারি না। শুধু ভাল ব্যবহার ছাড়া। সব পরিচালক খারাপ। আর আমি আর আমার ছেলেই একমাত্র ভাল। কেচ্ছা রটিয়ে কি বাংলা ছবি এগোবে?



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.