এ দিক-সে দিকে পলেস্তারা খসে পড়ছে। সংস্কারের অভাবে ধুঁকছে ডেবরার কাঁকড়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। নারায়ণগড়ের মকরামপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও একই ছবি। একটি-দু’টি নয়, পশ্চিম মেদিনীপুরের অধিকাংশ প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এমনই অবস্থা। অথচ জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশন থেকে প্রাপ্ত ‘নিঃশর্ত অনুদান’-এর এক কোটি ২৫ লক্ষ টাকা পড়েই রয়েছে। বরাদ্দ খরচ করতে না-পারায় এ বছর প্রাপ্তির ঝুলি থাকবে বিলকুল ফাঁকা। আরও ১০টি জেলা ওই একই কারণে চলতি বছরে পাচ্ছে না কোনও টাকা। ফলে এ বছর ৩ কোটি ৮৫ লক্ষ টাকা হারানোর সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আর গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবায় হাজার সমস্যা সত্ত্বেও খরচ না হয়ে পড়ে রয়েছে ৬ কোটি ৭২ লক্ষ টাকা।
নিঃশর্ত অনুদানের টাকা (কেন্দ্র প্রতি বছরে ৫০ হাজার টাকা দেয়) ঘর সারানো, রঙ করা, যন্ত্রপাতি, ওষুধ, রোগীদের স্বাচ্ছন্দ্যের নানা ব্যবস্থার জন্য খরচ করা যায়। অধিকাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চাহিদা অনেক। তা হলে টাকা খরচ হচ্ছে না কেন?
অভিযোগ উঠেছে রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্যদের দিকে। তাঁদের উপরেই ওই অনুদান খরচের দায়িত্ব। কিন্তু তাঁরা অনেকে বৈঠকেই আসেন না। বিশেষত তৃণমূল সরকার এসে সমিতির সভাপতি পদে জেলা পরিষদের সদস্যের বদলে বিধায়ককে বসায়। বৈঠকের জন্য সময়ই দিতে পারেন না অধিকাংশ বিধায়ক, তাই সিদ্ধান্ত হয় না। কোলাঘাটের তৃণমূল বিধায়ক বিপ্লব রায়চোধুরী মাছিনান ও নন্দাইগাজন প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের রোগী কল্যাণ সমিতির সভাপতি। বেহাল এই দুই স্বাস্থ্যকেন্দ্র বরাদ্দ টাকা খরচ করতে পারেনি। বিধায়কের কথায়, “এত কাজ থাকে যে সময় দিতে পারি না সব সময়।”
নিয়মের ফাঁদেও আটকে থাকে কাজ। কোনও প্রকল্পে যদি ৬০-৭০ হাজার টাকা প্রয়োজন হয়, তখন বাড়তি টাকার জন্য অন্যত্র দরবার করতে হয়। সেখানে সাড়া না-পেলে কাজ শুরু করা যায় না। অনেক সময় আবার পরিকল্পনাতেই গলদ থাকে। বিভিন্ন দফতরের মধ্যে সমন্বয়ের অভাবে অর্থ এসে পড়ে থাকলেও তা কাজে লাগানো যায় না। পশ্চিম মেদিনীপুরের মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সবিতেন্দ্র পাত্রের দাবি, “অনেক সময় কাজ হলেও ইউটিলাইজেশন সার্টিফিকেট জমা পড়ে না। ফলে খরচ দেখানো যায় না।”
কিন্তু রাজ্য স্তরে গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের সঙ্গে যুক্ত এক আধিকারিক জানান, রোগী কল্যাণ সমিতিগুলির টাকা খরচে ব্যর্থতা নিয়ে সরকারও চিন্তিত। দু’টি বেসরকারি সংস্থাকে দিয়ে এ বিষয়ে সমীক্ষা করানো হয়েছে, সব জেলাকে নিয়ে আলোচনা সভাও হয়েছে। ব্যর্থতার কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখা যাচ্ছে, টাকার পরিমাণ খুব বেশি না হলেও, তা খরচ করতে চাইলে সরকারি নানা নিয়ম মানতে হয়। নানা স্তরের কর্তৃপক্ষকে নোটিস দেওয়া, ক্যাশ এবং লেজার বই যথাযথ রাখা, ব্যাঙ্ক স্টেটমেন্ট জোগাড় রাখা, এর কোনওটিতে গণ্ডগোল হলে দায়িত্ব বর্তায় মেডিক্যাল অফিসারের উপর। অথচ এই কাজগুলি করার কোনও সরকারি কর্মী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নেই। ব্লক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের হিসেব রক্ষকের উপর ৩০-৪০টি উপস্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং চার-পাঁচটি প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের দায়িত্ব। তাই টাকা খরচ না করাই নিরাপদ মনে হয় মেডিক্যাল অফিসারদের কাছে। এর প্রতিকার করতে মাল সরবরাহকারীদের (ভেন্ডার) তালিকা আগাম পাঠিয়ে ভাল ফল পাওয়া গিয়েছিল বীরভূমে। কিন্তু সেই পদ্ধতি বাকি জেলায় কার্যকর হয়নি।
গ্রামের মানুষের তরফে চাপ থাকলে হয়তো খরচের পরিমাণ বাড়ত। সেই উদ্দেশেই নিঃশর্ত তহবিলের বরাদ্দ ও খরচের হিসেব প্রকাশ্যে টাঙিয়ে দেওয়ার নিয়ম আছে। কিন্তু সমিতিতে স্থানীয় বাসিন্দার আসনগুলিতে প্রধানত রাজনৈতিক ব্যক্তিরা থাকেন বলেই সেই চাপ কাজ করে না, মনে করছেন ওই আধিকারিক। স্বচ্ছতার অভাবে নিঃশর্ত তহবিল অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে।
জাতীয় গ্রামীণ স্বাস্থ্য মিশনের রাজ্য অধিকর্তা সঙ্ঘমিত্রা ঘোষ জেলাশাসকদের চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন, আগের বরাদ্দ খরচ না হওয়া পর্যন্ত চলতি বছরে ১১টি জেলায় অর্থ বরাদ্দ করা হবে না। যে আটটি জেলা কিছুটা হলেও খরচ করতে পেরেছে, তাদেরই বরাদ্দ করা হবে। এই খাতে মোট ৯০৯টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের জন্য যেখানে বরাদ্দ হওয়ার কথা সাড়ে চার কোটি টাকা, সেখানে আটটি জেলা পাচ্ছে মাত্র ৬৮ লক্ষ টাকার মতো। ফলে বিকেন্দ্রিত প্রশাসন ব্যবস্থা বেশি কার্যকর কি না, সেই প্রশ্নও উঠে গেল। |