দিল্লির গণধর্ষণের ঘটনায় তরুণীর মৃত্যুর খবরে ব্যথিত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভবিষ্যতে এই ধরনের ঘটনা আটকাতে আরও কড়া আইনও চান তিনি। অথচ পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণের অভিযোগকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলার পরেও তিনি অনুতপ্ত নন! তাঁর সরকারের পুলিশ ওই ঘটনার চার্জশিট দিয়ে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে জানালেও মুখ্যমন্ত্রী অভিযোগকারিণীর উদ্দেশে দুঃখপ্রকাশ করেননি। তাঁরই দলের এক সাংসদ ও ঘনিষ্ঠ নাট্যকর্মী পার্ক স্ট্রিটের ঘটনা ও অভিযোগকারিণীর বিরুদ্ধে কুরুচিকর কথা বললেও অবিরত মন্তব্যে অভ্যস্ত মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে রা কাড়েননি!
তিন দিন উত্তরবঙ্গ সফরের পরে শনিবার কলকাতায় ফেরেন মুখ্যমন্ত্রী। তার আগে বাগডোগরা বিমানবন্দরে দিল্লির ঘটনা নিয়ে তিনি বলেন, “আমি শোকাহত, মর্মাহত। বীভৎস ঘটনা। এর নিন্দা করার কোনও ভাষা নেই। আমাদের দেশে আইপিসি, সিআরপিসি রয়েছে। কিন্তু আইনগুলি অনেক পুরনো। নতুন করে কী করতে হবে, তা কেন্দ্রীয় সরকার ঠিক করবে। এ ক্ষেত্রে সরকার আমাদের সহযোগিতা পাবে। সব রাজনৈতিক দলকে নিয়ে আলোচনা বা বিশেষ অধিবেশন হতে পারে।” একই সঙ্গে দোষীদের কড়া এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিও করেন তিনি।
মুখ্যমন্ত্রী যখন এ কথা বলছেন, তখন তাঁর রাজ্যেই ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে তাঁরই ঘনিষ্ঠ এবং দলীয় নেতারা নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া দিচ্ছেন, যা নিয়ে ঝড় উঠছে সব মহলে। এ প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর সতর্ক মন্তব্য, “প্রত্যেককে সংযমী হতে হবে। প্রতিটি ঘটনা নিন্দনীয়। এই ক্ষেত্রে মানসিকতার বদল প্রয়োজন।” মুখে এ কথা বললেও গত কালই তাঁর দলের সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার বা গত বুধবার তাঁর ঘনিষ্ঠ নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ প্রসঙ্গে যে মন্তব্য করেছেন, সে প্রসঙ্গ এড়িয়েই গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। এ দিন রাজারহাটে মুখ্যমন্ত্রী ইকো-ট্যুরিজম পার্কের উদ্বোধন করেন। লক্ষ্মণীয় ভাবে সেই অনুষ্ঠানে স্থানীয় সাংসদ কাকলি ঘোষদস্তিদার কিন্তু অনুপস্থিত ছিলেন।
দিল্লির তরুণীর মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার পরেই কলকাতার পুলিশ কমিশনার রঞ্জিৎ কুমার পচনন্দা মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধ রুখতে কিছু ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছেন। শহরের সব থানার ওসি-দের প্রতি তাঁর নির্দেশ, মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনার অভিযোগ নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
|
|
যে সব নেতা মেয়েদের নিয়ে কুরুচিকর মন্তব্য করলেন, কোনও দলই তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না। এখন প্রশ্ন হল, তাঁরা যদি নিজেদের ঘর পরিষ্কার না করতে পারেন, সে ক্ষেত্রে আমরা কি ওদের কাছ থেকে সমাজকে পরিচ্ছন্ন রাখার আশা করতে পারি?
ফারহান আখতার |
|
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, মমতার বক্তব্য বা সিপি-র উদ্যোগ সঙ্গত। কিন্তু দিল্লির ধর্ষণ নিয়ে যিনি সরব, তিনি পার্ক স্ট্রিট নিয়ে কেন উদাসীন, সেই প্রশ্নও উঠেছে। ক’দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী দিল্লি ধর্ষণ নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গে যদি ধর্ষণ বা ইভটিজিংয়ের ঘটনা ঘটে, সে ক্ষেত্রেও আমি প্রতিবাদ করব।” অথচ তাঁর আমলেই পার্ক স্ট্রিট, কাটোয়া, বরাহনগরে ধর্ষণের অভিযোগ উঠেছে। পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডকে ‘সাজানো ঘটনা’ বলেছেন, কাটোয়ায় রাজনৈতিক রং খুঁজে পেয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই!
এবং তিনি প্রতিবাদ করেছেন, এমন নজিরও নেই। গত বুধবার তৃণমূলপন্থী নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ দিল্লি ও পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার প্রেক্ষিত ও গতিপ্রকৃতি আলাদা দাবি করে বলেছিলেন, “পার্ক স্ট্রিটে মহিলা মধ্যরাতে স্বেচ্ছায় একটি গাড়িতে উঠেছিলেন।” সেই সঙ্গেই তাঁর যুক্তি, “আঙুল তুলতে হলে অভিযোগকারিণীর দিকেই তুলতে হবে। কারণ উনি প্রথমে ভুল লোককে শনাক্ত করেছিলেন।” অর্পিতার পথেই আরও কদর্য ভাষায় পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার অভিযোগকারিণীকে আক্রমণ করেছেন কাকলি ঘোষদস্তিদার। শুক্রবার তিনি বলেন, “পার্ক স্ট্রিটে আদৌ কোনও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। পার্ক স্ট্রিটে যা হয়েছে তা হল পেশাদার কাজকর্ম নিয়ে ওই মহিলা এবং তাঁর খদ্দেরদের মধ্যে গোলমাল।” প্রশ্ন উঠছে, রাজ্যে ধর্ষণ ও মহিলা নির্যাতনের একাধিক অভিযোগ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মনোভাবের জন্যই কি পার্ক স্ট্রিট-কাণ্ডের মূল অভিযুক্ত আজও অধরা? এই জন্যই কি কাকলি, অর্পিতারা বিরূপ মন্তব্য করেও ছাড় পেয়ে যাচ্ছেন?
মুখ্যমন্ত্রীর মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠছে রাজ্য জুড়ে। স্বাভাবিক ভাবেই সরব বিরোধীরাও। এ দিন রানি রাসমণি রোডে খুচরো ব্যবসায় এফডিআই-এর পক্ষে সওয়াল করতে সভা ডেকেছিল কংগ্রেস।
কিন্তু দিল্লির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য ওই সভাকে শোকসভা করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুষ্ঠানেই পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড নিয়ে রাজ্য সরকারকে কড়া আক্রমণ করে কেন্দ্রীয় নগরোন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী দীপা দাশমুন্সী বলেন, “দিল্লির ঘটনা নিয়ে আরও কড়া আইনের কথা ভাবছে কেন্দ্রীয় সরকার। আর পার্ক স্ট্রিটের ঘটনায় প্রধান অভিযুক্তকে আজও গ্রেফতার করা গেল না! এটা রাজ্যের ব্যর্থতা।”
কাকলি ঘোষদস্তিদারের মন্তব্যের কড়া সমালোচনা করে দীপা বলেন, “ধর্ষণে আমাদের রাজ্য দেশে দ্বিতীয় স্থানে। মেট্রো শহরগুলির মধ্যে ধর্ষণে কলকাতা তৃতীয় স্থানে। এটা আমাদের লজ্জা।” মুখ্যমন্ত্রীর নাম না করে দীপা বলেন, “রাজ্যে ধর্ষণ বাড়ছে। সরকার ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
এর জন্য আপনাকে কেউ ক্ষমা করবে না।”
কেন্দ্রীয় রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীও মুখ্যমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করেন। তাঁর প্রশ্ন, “ধর্ষণের ঘটনার কম-বেশি বাছবিচার করছেন কেন? এটা এক ধরনের বিকৃতি।” রাজনৈতিক স্বার্থে ধর্ষণের ঘটনাকে আড়াল করার চেষ্টা হচ্ছে বলে অভিযোগ করে তিনি বলেন, “তৃণমূলের মহিলা সাংসদের মন্তব্যে পার্ক স্ট্রিটের নির্যাতিতাকে বোঝানো হচ্ছে, তুমি তোমার দোষে ধর্ষিতা হয়েছ! অথচ মূল অভিযুক্ত ধরা পড়ছে না।” অধীরের প্রশ্ন, “নির্বাচিত সরকার ধর্ষককে রক্ষা করতে অবতীর্ণ হলে মানুষ আর কী আশা করতে পারে?”
সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডেকে কড়া আইনের কথা বলেছেন মমতা। তার সমালোচনা করে প্রাক্তন মন্ত্রী মানস ভুঁইয়া বলেন, “রাজ্যের হাতে যে আইন রয়েছে তাতেই ধর্ষণকারীদের কঠোর শাস্তি দেওয়া যায়। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছার প্রয়োজন।” প্রায় একই সুরে অধীরের দাবি, “এই আইনেই ধর্ষণকারী ধনঞ্জয়কে ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল।”
|