তিনি যেতে চাননি। তবু যেতে হয়েছে তাঁকে।
সঈদ আজমলের সঙ্গে ‘ডুয়েলে’ নামতে চেয়েছিলেন। চেয়েছিলেন দু’টো ওয়ান ডে সিরিজ খেলে প্রস্ততি নেবেন অজি-যুদ্ধের। কিন্তু চাওয়া-পাওয়ার হিসেব মিলল কোথায়? বদলে শুনতে হয়েছে বোর্ড প্রেসিডেন্টের অমোঘ-নির্দেশ‘আর নয়। পরবর্তী বিশ্বকাপের নকশায় তুমি নেই, অতএব এখনই...।’
গত এক বছরে সব ওয়ান ডে খেলেননি তিনি। নামতেন বেছে বেছে। তবু তো একটা ভরসা থাকত, এই সিরিজে নেই, কিন্তু পরের সিরিজে দরকারে নামবেন ঠিক। দেশের সম্মানহানি কবে চুপচাপ বসে দেখেছেন ক্রিকেট-ঈশ্বর?
নির্মম বাস্তব বরাবরই অবিশ্বাসের বিষয়বস্তু। কিন্তু ঘোর অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, শনিবার থেকে টিভি খুললে আর ওয়ান ডে জার্সিতে দেখা যাবে না ‘মিস্টার ইন্ডিয়ান ক্রিকেট’কে। উইকেটে তাঁর ‘গার্ড’ নেওয়ার সময় শোনা যাবে না আসমুদ্রহিমাচলের গর্জন। তাঁকে না দেখে অনেকে ‘ধুত্তোর’ বলে টিভি বন্ধ করবেন, কিন্তু তিনি সচিন রমেশ তেন্ডুলকর, আর ভারতের ওয়ান ডে জার্সি পড়ে নামছেন না। পাকিস্তান কেন, কারও বিরুদ্ধেই না। তেইশ বছর পর ওয়ান ডে দুনিয়াকে লিটল মাস্টারের চিরবিদায়।
কিন্তু সত্যিই কি? তা হলে খোদ বোর্ড প্রেসিডেন্টের শহরে সচিনকে রাতারাতি ‘ব্রাত্য’ করে দেওয়া নিয়ে যে ছাইচাপা আগুনের সন্ধান পাওয়া গেল, ওগুলোর কী মানে? মহেন্দ্র সিংহ ধোনিও সাংবাদিক সম্মেলনে বসে সচিন-প্রসঙ্গে অস্বস্তিতে পড়লেন কেন? কেন সহ্য করলেন মিসবার ‘চিমটি’?
উত্তরটা সহজ। সচিন তেন্ডুলকরের শরীরী উপস্থিতি নেই। কিন্তু সচিন না থেকেও আছেন। আছেন টিমের মননে। মস্তিষ্কে।
শনিবার দুপুর-দুপুর চেন্নাই ক্রিকেট সংস্থায় ঢুঁ মেরে আশ্চর্য এক আলোচনার সন্ধান মিলল। পেলের দশ নম্বর জার্সির উত্তরাধিকার পরবর্তী কালে পেয়েছেন অনেকে। জিকো। পরে রোনাল্ডিনহো। মারাদোনার দশ নম্বর যেমন এখন মেসির দখলে। কিন্তু সচিনের দশ-টার কী হবে? কেউ পরবেন? না তুলে রাখা হবে? শ্রীনিবাসনের কোপে পড়বেন বলে কেউ সরাসরি বিক্ষোভের রাস্তায় যাচ্ছেন না। কিন্তু বোর্ডের সঙ্গে যুক্ত থাকা এক কর্তাকে বলতে শোনা গেল, “নামটা লিখবেন না। কিন্তু এটা বিশ্বাস করা খুব কঠিন যে তেরো বছর পর চিপকে আবার ভারত-পাকিস্তান হবে, আর সচিন থাকবে না। চিপকে আক্রমের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওর ওই সেঞ্চুরি আজও কেউ ভোলেনি। পিঠের অসহ্য যন্ত্রণা সামলে নিয়ে ও রকম একক যুদ্ধ ভারতীয় ক্রিকেটে ক’টা আছে?” চেন্নাইয়ের আকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ওই কর্তার মুখে ভিড় করে থাকে মনখারাপের মেঘ।
বর্ষণটা হল একটু পরে। বিকেল ছ’টা নাগাদ। সেটাও চেন্নাইয়ের আকাশের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই। তবে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের। |
হাসিখুশি নাকি হাসির অভিনয়? টিম হোটেলে শনিবার। ছবি: উৎপল সরকার |
ধোনি ঠিক করে বসতেও পারেননি তখন সাংবাদিক সম্মেলনে। এক সাংবাদিক পাশে দাঁড়ানো বোর্ড মুখপাত্রকে জিজ্ঞেস করলেন, “আজ সচিন নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে কি?” উত্তরে একটা সামান্য কাঁধ ঝাঁকানো এল। ধোনিকে জিজ্ঞেস করা হল, সচিনকে ওয়ান ডে সংসারে ঠিক কতটা মিস করবে টিম ইন্ডিয়া? জবাবে দু’টো উত্তর দিলেন ধোনি:
এক) যদি সচিনের সরকারি অবসরের সিদ্ধান্ত নিয়ে মতামত জানতে চান, তা হলে বলব ওকে নিশ্চয়ই মিস করব আমরা। ড্রেসিংরুমে পাজির প্রভাব ছিল মারাত্মক। জুনিয়রদের কত পরামর্শ দিত।
দুই) কিন্তু যদি গত এক বছর দেখেন, দেখবেন পাজি সব ম্যাচ খেলেনি। বেছে খেলেছে। এই পরিস্থিতির জন্য আমরা বিশেষ ভাবনায় নেই। কারণ, এটা নতুন নয়। আমাদের সামনে তাকাতে হবে। নতুনদের দায়িত্ব নিতে হবে।
দুই উত্তরের মধ্যে ভারত অধিনায়ক নির্যাসটা কী ধরতে চাইলেন, ঠিক বোঝা গেল না। কিন্তু সচিন না থাকলে কী হবে বা হতে পারে, সেটা পাকিস্তান অধিনায়ক পরিষ্কার করে দিয়ে গেলেন।
এ দিন বৃষ্টির চোটে দু’টো দলের কেউই চিপকের দিকে যায়নি। পরে মিসবা বলছিলেন, “সচিনের না থাকাটা কিন্তু ভারতকে ভোগাবে। ওয়ান ডে-তে ওর উনপঞ্চাশটা সেঞ্চুরি আছে। সচিনের প্রভাব ভুলে নামাটা মুখের কথা?” আর ভোগান্তির রূপরেখাটাও দিব্যি দিয়ে গেলেন পাক অধিনায়ক। ওয়ান ডে টিমে বেশ কয়েকটা বদল হচ্ছে। অভিজ্ঞ ইউনিস খান ঢুকেছেন, আছেন তরুণ প্রতিভা আজহার আলি। মারকুটে হাফিজের সঙ্গে মিসবা। সাত ফুটের মহম্মদ ইরফানকেও রেখে দেওয়া হয়েছে। পাথুরে মুখে মিসবা বলছিলেন, “মাঠে ঝামেলা বাধিয়ে আগ্রাসন দেখানো কাজের কথা নয়। দেখাতে হলে দেড়শো কিলোমিটারে বল করে দেখাও। বোলারদের তুলোধোনা করে দেখাও।” উলটো দিকে ধোনিকে দেখে মনে হবে ভুলভুলাইয়ায় বন্দি! ওয়ান ডে-র নিয়ম বদল নিয়ে রাগ। বলে ফেলছেন, “আমার হাতে ওভারে একটা বাউন্সার দেওয়ারই লোক নেই, তো দু’টো!” সহবাগের ফিরে আসাতেও বিশেষ স্বস্তির খোঁজ নেই, বরং মিডিয়াকে এক হাত, “এ রকম নির্বিকার মুখ করে প্রেস কনফারেন্সে আসি কেন জানেন? কারণ জানি, ঠিক কী ধরনের প্রশ্ন আসবে। অনেক কিছুই তো চারপাশে পালটাচ্ছে। মিডিয়ার বিশ্লেষণও।”
শুনলে ধন্দ লাগবে। জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হবে, চব্বিশ ঘণ্টা আগের আমদাবাদে তা হলে কারা হারল? পাকিস্তান? না, ভারত?
না কি দেশ জুড়ে যে আলোচনাটা চলছে সেটাই সত্যি? ‘এসআরটি’-বিদায়ের ধাক্কা সামলানোর মতো সাবালক আজও হয়নি ভারতীয় ক্রিকেট! |