তিন ক্রিকেটবিপ্লবের জনকের মৃত্যু
মর্মান্তিক, এখনও যে ব্যাট করছিলেন
স্কোরবোর্ডকে গাধা বলেছিলেন নেভিল কার্ডাস। অ্যান্টনি উইলিয়াম গ্রেগ জন্মের অন্তত দশ বছর আগে।
স্কোরবোর্ড সত্যিই গাধা। কারণ আটান্ন টেস্টে ৪০.৪৩ দিয়ে টনি গ্রেগকে ব্যাখ্যা করার কোনও উপায় নেই। সমকাল হয়তো তাঁকে সে ভাবেই মেপেছে।
ভবিষ্যৎ হরগিস মাপবে না। বক্সিং ডে টেস্টের দ্বিতীয় দিনে ক্যানসারের কোলে ঢলে পড়া গ্রেগকে বরঞ্চ ভাবীকাল মাপবে গ্যারি সোবার্সোচিত উচ্চতায়! ব্যাট, বল আর ফিল্ড তিনটেই সম্মানজনক ভাবে করতেন বলে নয়। গ্রেগ এমন একজন মানুষ যিনি ক্রিকেটারদের মধ্যে তিনটে ব্যাপারে অগ্রণী ছিলেন। রেকর্ড খাতায় জন্মদাতার সেই প্রভাব গোনার মতো স্ট্যাটিস্টিশিয়ান এ মুহূর্তে নেই। ভবিষ্যতে আসবে। যারা হিসেব করবে ৩৫৯৯ রান + ১৪১ উইকেট + তিন সফল বিপ্লবের জন্মদাতা = মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া সোবার্সোচিত পরিসংখ্যান!
ক্রিকেট অনেকেই সফল ভাবে খেলে। ধারাবাহিক সেঞ্চুরি করে। উইকেট নিয়েই চলে সব দেশে। কিন্তু খেলতে খেলতে এবং খেলার পরে বিপ্লবের জন্ম দেয় কম লোক। জন্ম দিয়ে সেই বিপ্লব সফল করতে পারে তার চেয়েও অনেক অনেক কম শতাংশ।
টনি গ্রেগকে ২৯ ডিসেম্বর ২০১২-র পরেও প্রবল ভাবে মনে রাখতে হবে কারণ তিনি সেই বিরল, কম শতাংশের মধ্যে পড়েন।
ভারতের মাঠে ভারতীয় স্পিনার কী করে খেলতে হয়, ইংরেজদের প্রথম শিখিয়েছিলেন।
ক্রিকেটারদের প্রাপ্য পারিশ্রমিকের জন্য প্রথম বিদ্রোহ করেছিলেন।
ধারাভাষ্যে বৃহত্তর আমজনতার কথা প্রথম ভেবে পরিবর্তন এনেছিলেন।
স্মৃতির ইডেন। ১৯৭৭
সেই কবে ইডেনের মাঠে গ্রেগ জনতার হৃদয় জিতে নিয়েছিলেন হাঁটু গেড়ে করা নমস্কারে। অনেকে তখন বলেছিল
গ্যালারি নিচ্ছে। পরে বোঝা গেছিল মোটেও নিছক গ্যালারি নেওয়া ছিল না। ওটা ছিল বুদ্ধিদীপ্ত গেমসম্যানশিপ।
লাট্টুর মতো ঘোরা পিচে আবার গ্যালারিতে আশি হাজার উত্তেজিত শত্রুও উপস্থিত থাক, চাননি গ্রেগ।
ইডেন জনতার সঙ্গে দ্রুতই আপসে এসেছিলেন।
কোনও কোনও ক্রিকেট সমালোচক ভারতীয় বোর্ডের দাদাগিরির বিরুদ্ধে তাঁর সাম্প্রতিক আন্দোলনকেও এরই সঙ্গে যুক্ত করতে চাইবেন। কিন্তু সেটা হয়তো ব্যর্থ বিপ্লব বলে তালিকায় পরে আসবে। গুরুত্বেও সমপর্যায়ের নয়। সমতুল্যই নয় আনা সফল বিপ্লবগুলোর সঙ্গে।
সে দিন আধুনিক ভারতের নামী স্পিনার বলছিলেন, “প্লিজ পুরনো স্পিনারদের সঙ্গে আমাদের তুলনা করবেন না। আমরা আনকভার্ড পিচ পাইনি। হাল্কা তখনকার ক্রিকেট ব্যাট পাইনি। স্পিন খেলতে চূড়ান্ত অনভিজ্ঞ বিদেশিদের পাইনি।” পুরনো স্পিনার বলতে সত্তর দশকের নামীদামি ভারতীয় বোলার। যাঁদের ঘিরে সত্যিই পিসি সরকারের ওয়াটার অফ ইন্ডিয়ার মতো প্রাচ্যের রহস্যময়তা ছিল। ভারতের মাঠে বিদেশিরা ব্যাট করতে নামার আগেই তাই আউট হয়ে আসত। বিলেতের দল হলে তো কথাই নেই। ভারতে পাওয়া জলের মতোই মানসিক কুয়াশা ছিল স্পিন খেলতে পারা নিয়ে।
টনি গ্রেগ সুয়েজের ধারের প্রথম লোক যিনি প্রাচ্যের ইন্দ্রজাল টুকরো টুকরো করে ছিঁড়তে শুরু করেন। এ বার পিটারসেন-কুকদের স্পিনের মাস্টারি নিয়ে এত প্রশংসা হল। লম্বা বাঁ পা-টা সামনে যথাসম্ভব বাড়িয়ে স্পিনের বিষ শুরুতেই খতম করে দেওয়াস্পিন সাপুড়ের এই মোহনবাঁশিটা কিন্তু গ্রেগই প্রথম বাজান। তিন স্পিনার এবং ফরোয়ার্ড শর্ট লেগে সোলকারএই মরণযুদ্ধের মুখে প্রথম ভারত সফর থেকে গ্রেগ ফেরেন ৪১.৫০ গড় নিয়ে। পরের সফরে সেই গড় বেড়ে দাঁড়ায় ৪২.৭৫। দুটো সফরেই সেঞ্চুরি ছিল একটা করে। বেদি-চন্দ্রশেখরকে তার আগে দেশের মাঠে ধারাবাহিক ভাবে এত নির্জীব করে দিতে আর কেউ পারেননি। গ্রেগ সেই যে মডেল দেখালেন, পেটেন্ট করার উপায় থাকলে আজও তাঁর স্ত্রী ভিভিয়ান আর চার ছেলেমেয়ে তার টাকায় জীবিকানির্বাহ করতে পারতেন। ভারতের মাঠে স্পিন বোলিং খেলার আজও এটাই সবচেয়ে সর্বজনগ্রাহ্য স্টাইল।
নিজের এবং ক্রিকেটারদের জন্য বিপ্লবে আত্মাহুতিও সবার আগে দেন গ্রেগ। ইংল্যান্ড অধিনায়কত্ব চলে যায় তাঁর। প্যাকার সিরিজের বিখ্যাত চরিত্র হিসাবে আরও দুই অধিনায়ক নিয়মিত আলোচনায় আসেন। ইয়ান চ্যাপেল আর ক্লাইভ লয়েড। এঁরাও বিদ্রোহ করেছিলেন নিজের বোর্ডের বিরুদ্ধে। কিন্তু সেটা ছিল নিছক প্লেয়ার হিসেবে বিদ্রোহ। গ্রেগেরটা ছিল তার এক ধাপ ওপরে। সংশোধনবাদী হিসেবে আওয়াজ তোলা! কেরি প্যাকারের সহযোগী হিসেবে সেই বিপ্লবের ক্রিকেটীয় মুখ হিসেবে আগাগোড়া বিরাজ করেছিলেন তিনি। চ্যানেল নাইনে চাকরি করতেন গ্রেগ। বাকিদের মতো নিছক ধারাভাষ্যকার ছিলেন না। প্যাকার-সহযোগী লিন্টন টেলরের সঙ্গে ঘুরে ঘুরে সারা পৃথিবী থেকে গ্রেগ প্লেয়ার নিতেন। একই সঙ্গে ক্রিকেটার এবং বিদ্রোহী সংস্থার কর্মকর্তা হওয়ার সবচেয়ে চড়া মূল্য তাঁকেই সবচেয়ে বেশি চুকোতে হয়। কখনও আর খেলার সুযোগ পাননি ইংল্যান্ডের হয়ে।
ধারাভাষ্যেও গ্রেগ নতুন ধারার প্রবর্তক। জেনারেশন ‘ওয়াই’ টিভিতে সেরা ক্রিকেটবিশ্লেষক বাছতে গেলে প্রথম পাঁচেও গ্রেগকে রাখবে কি না সন্দেহ। না রাখলে সেই বিচার সঙ্গতই হবে। রিচি বেনো, ইয়ান চ্যাপেলদের সেই আপাদমস্তক ক্রিকেটীয় সরণিতে ছ’ফুট ছ’ইঞ্চির দক্ষিণ আফ্রিকান নেই। কিন্তু তিনি আছেন পৃথক সরণি তৈরির কনস্ট্রাকশন কোম্পানির হেড হিসেবে। সেই কবে ইডেনের মাঠে গ্রেগ জনতার হৃদয় জিতে নিয়েছিলেন হাঁটু গেড়ে করা নমস্কারে। অনেকে তখন বলেছিল গ্যালারি নিচ্ছে। পরে বোঝা গেছিল মোটেও নিছক গ্যালারি নেওয়া ছিল না। ওটা ছিল বুদ্ধিদীপ্ত গেমসম্যানশিপ। লাট্টুর মতো ঘোরা পিচে আবার গ্যালারিতে আশি হাজার উত্তেজিত শত্রুও উপস্থিত থাক, চাননি গ্রেগ। ইডেন জনতার সঙ্গে দ্রুতই আপসে এসেছিলেন।
আসলে অন্য অনেক ক্রিকেটারের মতো নিজেদের অবস্থান সম্পর্কে কখনওই আত্মম্ভরী ছিলেন না গ্রেগ। তাঁর জীবনদর্শন ছিল, যারা খেলে তারা গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়ই। যারা সময় করে খেলাটা দেখে তারাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তাই দ্রুত একটা যোগাযোগ স্থাপন করে ফেলতেন। গ্রেগ-পূর্ব দর্শককে কনজিউমার মনে করার এই মানসিকতা ছিল না। ধারাভাষ্যেও সেই কনজিউমারিজমের প্রেক্ষিতটা আমদানি করেছিলেন। সবার আগে বুঝেছিলেন, বাড়িতে বসে ক্রিকেটভক্ত জো আর রবার্ট নিশ্চয়ই চ্যানেল নাইন দেখছে। কিন্তু জো-র মা আর রবার্টের গার্লফ্রেন্ড কি দেখছে? তাদের যদি দেখাতে হয়, পরিবেশনে অন্য প্রেক্ষিত আনতে হবে। অন্যরা হয়তো বললেন, কলম্বো উইকেটে বল আজ বেশি সুইং করছে। গ্রেগ তিনি বলবেন, কলম্বোর বাজারে আজ কলা পাওয়া যাচ্ছে না। অথচ ক্রিকেট মাঠে বল হাওয়ায় বাঁক নিচ্ছে। এ রকম নানান গল্প তুলে আনতেন। কণ্ঠস্বরে নাটক আনতেন। ম্যাচ গড়াপেটার মতো বিতর্কিত বিষয় এবং সরফরাজ নওয়াজকে নিয়ে বলতে ভয় পেতেন না। টোন-টা লাইট রাখতেন। সব মিলিয়ে একটা রং তৈরি হত। তাঁর ধারাভাষ্যের সেই কালার আর সহ-ভাষ্যকারের নিখাদ ক্রিকেটবিশ্লেষণ, দুইয়ে মিলে যে কম্বিনেশন তৈরি হত তা গ্রেগের অসুস্থতা ইস্তক চ্যানেল নাইন শ্রোতারা ভরপুর মিস করতে শুরু করেছেন। অথচ কালার কমেন্ট্রির স্টাইল অনেকেই নিয়েছেন। বয়কট আছেন। সিধু এসেছেন মোটা কোটেশন বই-সহ। কিন্তু ক্রিকেট আর নাটকের মিশ্রণটা এত ভাল মাখতে আর কেউ পারেননি।
ক্রিকেটপৃথিবীর কাছে মর্মান্তিক হল, নিছকই অবসর নেওয়া এক প্রাক্তন অধিনায়ক শনিবার সিডনিতে মারা গেলেন না। নিছক এই ক্যাটেগরির হলে তার অতীত স্মরণ করেই শ্রদ্ধাপ্রকাশ করা সম্ভব ছিল।
কিন্তু এই লোকটা তো অবসর নিয়েও বহু বছর নতুন ব্যাটে খেলছিল!


অ্যান্টনি উইলিয়াম গ্রেগ
(১৯৪৬-২০১২)
টেস্ট: ৫৮ ইনিংস: ৯৩, রান: ৩৫৯৯, গড়: ৪০.৪৩, সেঞ্চুরি: ৮, হাফ-সেঞ্চুরি: ২০, সর্বোচ্চ রান: ১৪৮, উইকেট: ১৪১
ওয়ান ডে: ২২ ইনিংস: ১৯, রান: ২৬৯, গড়: ১৬.৮১, উইকেট: ১৯




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.