দেশের সবথেকে বড় টুর্নামেন্ট আই লিগ থেকে আড়াই বছরের নির্বাসন। সঙ্গে বিশাল জরিমানা। দু’বছর পর আই লিগ খেলতে হবে ছোট ক্লাবগুলির সঙ্গে, দ্বিতীয় ডিভিশনে। ডার্বি ম্যাচের বিরতিতে দল তুলে নেওয়ায় এই হল মোহনবাগানের তিন দফা সাজা।
ভবিতব্যই ছিল শাস্তি। তবু শনিবার দুপুরে ক্ষীণ আশা নিয়ে মোহনবাগান তাঁবুর ভিতরে-বাইরে অপেক্ষা করেছেন সদস্য-সমর্থকরা। রেড অ্যালার্টে মোড়া দিল্লির ফুটবল হাউস থেকে শেষ পর্যন্ত দুঃসংবাদটা এসে পৌঁছতেই আবেগের নজিরবিহীন বিস্ফোরণ ঘটল গঙ্গাপারের ক্লাবে। কর্তাদের ঘিরে প্ল্যাকার্ড হাতে টানা বিক্ষোভ-কটূক্তি, রেলিঙে মাথা ঠুকে কান্না, বুক চেপে ধরে ক্লাবের লনে প্রবীণদের যন্ত্রণার গড়াগড়ি, গোষ্ঠ পাল সরণিতে অবরোধ কিছুই বাদ গেল না।
আই লিগের শাস্তি সংক্রান্ত কোর কমিটির এ দিনের সভার শুরুতেই চেয়ারম্যান এ আর খলিল ইস্টবেঙ্গলের প্রতিনিধিকে বলে দিয়েছিলেন, তিনি কোনও কথা বলতে পারবেন না। কারণ মাঠের লড়াইটা ছিল ইস্টবেঙ্গল বনাম মোহনবাগান। রাজ্য মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান, অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায়ের তেরো পাতার রায় পড়ার পর আই লিগের ধারা অনুযায়ী শাস্তির কথা জানিয়ে দেওয়া হয় মোহনবাগানকে। জরিমানার অঙ্ক ঠিক করতে ৯ জানুয়ারি সভা ডাকা হয়েছে।
মোহনবাগান অবশ্য ফেড কাপ, কলকাতা লিগ, আইএফএ শিল্ড, ডুরান্ড, রোভার্সে খেলতে পারবে। যদিও ফেডারেশনের এক কর্তা দিল্লি থেকে চরম বিরক্তি নিয়ে বললেন, “যে কারণ দেখিয়ে মোহনবাগান কর্তারা ডার্বি ম্যাচে দল তুলে নিয়েছেন, সে তুলনায় কম শাস্তিই হয়েছে। সব টুর্নামেন্ট থেকেই অন্তত এক বছরের জন্য নির্বাসন দরকার ছিল।” চুনী গোস্বামীর মতো আবার অনেক কট্টর মোহনবাগানীই চাইছেন কর্তাদের পদত্যাগ। চুনী বলছেন, “ফেডারেশনের সঙ্গে লড়াইয়ে না গিয়ে পদত্যাগ করুন কর্তারা।” সোশ্যাল নেটওয়ার্কে অবশ্য উপচে পড়ছে হতাশা আর ক্ষোভ। কোথাও কর্তাদের বিরুদ্ধে, কোথাও ফেডারেশনের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে।
মোহনবাগানের শাস্তি মনে করাচ্ছে ১৯৮৯-এর ৩ সেপ্টেম্বর বিশ্বকাপের বাছাই পর্বের ব্রাজিল-চিলি ম্যাচ। ওই ম্যাচ হারলে চিলি ছিটকে যেত বিশ্বকাপ থেকে। ব্রাজিল ১-০ এগিয়ে থাকার সময় হঠাৎই ব্রাজিলের সমর্থক জনৈক রোজমেরি ডি মেলো জ্বলন্ত মশাল ছোড়েন চিলির গোলকিপারকে লক্ষ করে। মাটিতে পড়ে যান চিলির কিপার রবার্তো রোজাস। চিলির কর্তারা তাঁকে বাইরে নিয়ে আসেন। এই ঘটনার প্রতিবাদে পুরো টিম নিয়ে মাঠ ছাড়েন চিলি কোচ। ব্রাজিলের ২-০ গোলে জয় ঘোষণা করে ফিফা। স্বভাবতই, ’৯০ বিশ্বকাপ থেকে চিলি ছিটকে যায়। কিন্তু ১৯৯৪-এর বিশ্বকাপ থেকেও নির্বাসিত করা হয় চিলিকে। কারণ, ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, মশালটি সে দিন চিলি কিপারের গায়েই লাগেনি। তিনি চোট পাওয়ার অভিনয় করেছিলেন। ৯ ডিসেম্বর যুবভারতীতে অবশ্য ইটের আঘাতে মাথা ফেটেছিল মোহনবাগানের রহিম নবির। তাঁর অস্ত্রোপচারও হয়।
মোহনবাগান কর্তাদের এখনও দাবি, সে দিন দল তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঠিক ছিল। পুলিশ ও সঙ্গীদের ঘেরাটোপে বিক্ষোভ বাঁচিয়ে তাঁবুতে ঢোকা মোহনবাগান সচিব অঞ্জন মিত্র তোপ দেগেছেন সে দিনের রেফারি বিষ্ণু চৌহানের বিরুদ্ধে।
দৃশ্যত বিধ্বস্ত অঞ্জনের বক্তব্য, “ফুটবল খেলাটা নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মানুষের জীবন। আরও একটা ১৬ অগস্ট আমরা চাইনি। রেফারির উচিত ছিল খেলা বন্ধ করে দেওয়া।” পুরনো উদাহরণ টেনে অঞ্জন বলেন, “বল্টন-টটেনহ্যাম ম্যাচে হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন এক ফুটবলার। রেফারি খেলা বন্ধ করে দিয়ে বলেছিলেন, জীবনটা আগে। বেঙ্গালুরুতে যে ফেড কাপের ফাইনালে জুনিয়র মারা গেলেন, সেই ম্যাচে রেফারি বালু খেলা বন্ধ করেননি বলে তাঁকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। নবির ঘটনার পর কেন বিষ্ণুকেও সাসপেন্ড করা হবে না।”
অথচ ফেডারেশনের বিরুদ্ধে একটি শব্দও খরচ করেননি মোহনবাগান সচিব। বলেছেন, “ফেডারেশনের উপর আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। ওঁরা নিশ্চয়ই সব কিছু বিচার বিবেচনা করে দেখবেন।” কিন্তু ফেডারেশনের কমিটিই তো মোহনবাগানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে। ওই প্রশ্ন শুনে ‘আমার আর কিছু বলার নেই’ বলেই উঠে পড়েন অঞ্জন।
নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে তোপ দাগতে অভ্যস্ত মোহন-সচিব কেন ফেডারেশনের বিরুদ্ধে এ দিন নীরব থাকলেন, তা নিয়ে চলছে জল্পনা। রবিবার রাতেই মোহন-কর্তারা ইঙ্গিত পেয়েছিলেন, নির্বাসন হচ্ছেই। সেই থেকে আইনজীবীদের সঙ্গে আলোচনা চলছে।
অঞ্জনবাবু বললেন, “সোমবারের মধ্যেই সিদ্ধান্তে নেব, ফেডারেশনের কোনও ফোরামে আবেদন করব, না আদালতে যাব।”
তিন দফা শাস্তির মতো মোহনবাগানের সামনে এখন রেহাইয়ের পথও তিনটি। এক) ফেডারেশনের কার্যকরী কমিটির দ্বারস্থ হওয়া। দুই) আরবিট্রেশনে যাওয়া। দু’টি ক্ষেত্রেই যথাক্রমে কমিটি ও আরবিট্রেটর চাইলে শাস্তি তুলে নিতে পারেন। তিন নম্বর গন্তব্য আদালত। শনিবার বেশি রাতের খবর, কোর্ট নয়, প্রথম দু’টি রাস্তার যে কোনও একটিই বেছে নেওয়ার কথা ভাবছে মোহনবাগান। তবে আবেদন করতে হবে ৪৮ ঘণ্টা অর্থাৎ সোমবারের মধ্যে।
কর্তাদের এখনও আশা, ফেডারেশনের কোনও একটি কমিটিই তাঁদের স্বস্তি দেবে। সূচিতে মোহনবাগানের পরের খেলা রয়েছে ৫ জানুয়ারি মুম্বই এফ সি-র বিরুদ্ধে। মোহনবাগান সাজা মকুবের আবেদন করলে সে ক্ষেত্রে ফেডারেশন প্রেসিডেন্ট প্রফুল্ল পটেল কী করেন, সেটাই দেখার।
|
প্রশ্ন অনেক |
• ওডাফা-টোলগেদের কী হবে?
• আই লিগ কি ১৩ দলের হবে?
• অবনমনে কি দু’টির বদলে একটি দল যাবে?
• আই লিগে কি নতুন লিগ-টেবল?
• শাস্তি উঠে গেলে সেই লিগ-টেবলের কী হবে? |
|