|
|
|
|
প্রবন্ধ... |
সখা ত্বমেব |
দুঃশাসন নয়। যুধিষ্ঠিরও নয়। দ্রৌপদী যাঁকে পরম সহায় হিসেবে পেলেন, তিনি কৃষ্ণ। তাঁর বন্ধুত্বে
দখলদারি নেই। অধিকারের হিসেব না কষে ভালবাসার ধর্মে পৌরুষ নিজেকে শুদ্ধ করতে পারে। লিখছেন বিশ্বজিৎ রায় |
আমরা যে মেয়েটিকে দিল্লিতে ধর্ষণ করেছিলাম, সেই মেয়েটি চলে গেল। খুব সচেতন ভাবেই ‘আমরা’ শব্দটা ব্যবহার করছি। যারা ধর্ষক, আমরা অবশ্যই দাবি করব, আইন তাদের শাস্তি দেবে। সেই দাবিতে প্রতিবাদী হব আমি, আপনি, জনগণ। যে যার নিজের বিচারবুদ্ধি অনুসারে, অভিরুচি অনুসারে বলব, কেমন শাস্তি ন্যায্য। তর্কও করব তা নিয়ে। কিন্তু এই প্রতিবাদের মুহূর্তে যেন নিজেদের দিকে তাকাতে ভুলে না যাই। পুরুষ হিসেবে, অনেক সময়েই গোচরে বা অগোচরে পুরুষতন্ত্রের অংশ হয়েছি। প্রত্যক্ষ হিংসায় শামিল না হলেও গোপন হিংসায় মদত দিয়েছি। এই মুহূর্তটি তাই নিজেদের সংশোধনের মুহূর্ত। তার চেষ্টা শুরু করার মুহূর্ত। কী ভাবে নিজেদের বদলাতে পারি আমরা, পুরুষেরা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ফিরে গেলাম মহাভারতের খুব চেনা একটা অধ্যায়ে।
হস্তিনাপুর। কৌরবদের সভা। পাণ্ডবদের বড়দাদা যুধিষ্ঠির পণ রেখে পাশা খেলতে গিয়ে দানের পর দান হারছেন। হারতে হারতে শেষে যুধিষ্ঠির বললেন, ‘যিনি নাতিহ্রস্বা, নাতিদীর্ঘা, নাতিকৃশা ও নাতিস্থূলা,...কেশকলাপ দীর্ঘ, নীল ...ভর্ত্তার অভিলষিত গুণসমুদয়ে বিভূষিতা...যাঁহার সস্বেদ মুখপঙ্কজ মল্লিকার ন্যায়; মধ্যদেশ বেদীর ন্যায়, সেই সর্বাঙ্গসুন্দরী দ্রৌপদীকে পণ রাখিলাম।’ চুল কেমন, উচ্চতা কতটা, সবই বলে দিয়েছেন। আর যে ভরণ-পোষণ করে, সেই ভর্ত্তা বা স্বামী যা যা গুণ চায়, সবই মেয়েটির আছে। ঘামলে কেমন অপরূপ দেখায় তাঁকে, তাও বলেছেন। কখন ঘেমে ওঠে মেয়েদের মুখ? শ্রমে, রতিশ্রমেও। অন্যান্য শ্রমের সময় তো দ্রৌপদীকে এত ‘ইন্টিমেট’ ভাবে যুধিষ্ঠিরের দেখার কথা নয়। বনবাস তো তখনও ঘটেনি, রানি দ্রৌপদীর খুব একটা শারীরিক ধকল হয় না নিশ্চয়ই, দাসী-বাঁদি আছে। তা হলে? ঘেমে ওঠা মুখ মল্লিকার মতো, এই বিবরণ কি রতিকালের! হওয়া সম্ভব। খুবই সম্ভব। এর আগে পর্যন্ত ভাইদের যখন পাশায় পণ রাখছিলেন বড়দা, তখন তাদের গুণের কথাই বলছিলেন। ভীম ইন্দ্রের মতো যুদ্ধ করে, অর্জুন সব্যসাচী দু’হাতেই সমান দক্ষতায় তির ছুড়তে পারে, এই সব। দ্রৌপদীর বেলায় শরীর, শরীর। পাশা খেলায় মত্ত ধর্মরাজ অধিকারপরায়ণ স্বামী তখন, দ্রৌপদীর বন্ধু নন। বন্ধু হলে, সখা হলে বুঝতেন, এ ভাবে মেয়েটিকে জনসমক্ষে তুলে ধরা যায় না। |
|
তার পর সেই ভয়ানক দৃশ্যের জন্ম হল। আজকের দিল্লিতে যা হয়েছে, সে দিনের হস্তিনাপুরে তা-ই হয়েছিল, অন্য ভাবে। যুধিষ্ঠির যে ভাবে দ্রৌপদীর বর্ণনা দিয়েছিলেন, তাতে তো এমনিতেই কর্ণ-দুঃশাসনদের আনন্দের সীমা ছিল না। আর যুধিষ্ঠির হারলেন যখন, তখন কি আর তর সয়! এই তো সেই মেয়ে, যার স্বয়ংবর সভায় কৌরবেরা কিছু করে উঠতে পারেনি। এই তো সেই মেয়ে, যে কর্ণকে ফিরিয়ে দিয়েছিল। এই বার এই বার সুযোগ এসেছে, সুতরাং অন্তঃপুর থেকে প্রকাশ্য রাজসভায় টেনে আনা যাক। চুল ধরে টেনে এনে যুধিষ্ঠির বর্ণিত এই রমণীর শরীরকে বস্ত্রহীন করার চেষ্টা না করলে সমবেত উল্লাস উপভোগ করা যাবে কেন! পুরুষেরা সবাই মিলে চেটেপুটে খেলে তবেই তো আনন্দ। দেখার, চাখার আনন্দ। যে মেয়েকে পেতে চেয়ে তারা পায়নি, তার ওপর এ বার প্রতিশোধ। ঘৃণা আর হিংসা ছড়িয়ে দেওয়া।
সভাপর্বের এই ঘটনা পৌরুষের এক বিশেষ চেহারাকে তুলে ধরে। এই পুরুষ নারীকে পণ্য বলে মনে করে। যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মাত্মা পুরুষও পাশা খেলায় মত্ত অবস্থায় নারীকে উপভোগ্য সামগ্রী হিসেবেই বর্ণনা দেন। আর বস্তু যখন, তখন তার দখল নেওয়ার জন্য হামলে পড়ে পুরুষেরা। বস্তুর ইচ্ছে থাকে না, অনিচ্ছে থাকে না। আমরা তো এখনও বলি, যৌনকর্মীকে চাইলেই ধর্ষণ করা যায়, বিয়ে করা বউয়ের সঙ্গে বিহারের জন্য অনুমতি নিতে হয় না।
কিন্তু মহাভারতে পৌরুষের অন্য রকম রূপও আছে। সভাপর্বে সে দিন ভীষ্ম দ্রোণরা তমস্তকে বসে থাকলেও দ্রৌপদীর হয়ে এক জন গলা ফাটিয়েছিলেন। বিকর্ণ। দুর্যোধনের এই ভাইটির বীর হিসেবে বড় একটা খ্যাতি নেই। কিন্তু সে দিন তিনি মুক্তকণ্ঠে বলেছিলেন, দ্রৌপদীর প্রতি যা হয়েছে তা অভব্যতা। যুধিষ্ঠির অন্যায় করেছেন। অন্তত এক জন পুরুষ ছিলেন রাজসভায়, যিনি দখল করেন না, যখন দরকার তখন আপ্রাণ প্রতিরোধ করতে পারেন। পৌরুষের দেখনপনা নেই, প্রতিরোধের সাহস আছে তাঁর।
না, শুধু বিকর্ণ নয়, এই পর্বেই আমরা দ্রৌপদীর এক বন্ধুকে দেখলাম, যিনি শরীরের দিক দিয়ে পুরুষ, আচরণে বা মানসিকতার দিক দিয়ে চেনা পৌরুষের অবয়ব নয়। তিনি কৃষ্ণ। সখা কৃষ্ণ। সখা শব্দের যেন কোনও লিঙ্গ পরিচয় নেই। একটি মেয়ে তার চূড়ান্ত অপমানের দিনে যে বন্ধুটির কাছে সাহায্য নিচ্ছে, সে লিঙ্গময় পুরুষ নয়, সখা। তাকে সব বলা যায়, অপকটে চাওয়া যায় সহায়তা। সখা কৃষ্ণ তাঁর রমণীয় বন্ধুকে বস্ত্র প্রদান করেছিলেন। এই কৃষ্ণ নিষ্কাম সন্ন্যাসী নন। তীব্র ভালবাসায় সমর্থ মানুষ তিনি। কিন্তু দখলদার নন। সখা যে, বন্ধু যে, বন্ধুর জন্য তার মন-কেমন করতে পারে, অভিমান হতে পারে, বন্ধুর প্রতি তার গভীর ভালবাসা, কিন্তু অধিকারবোধ নেই। সে বলে: ‘তোমায় আমি পালতে চাই না, কাড়তে চাই না, চাইছি তোমার বন্ধুতা।’ কাজটা কঠিন, অসম্ভব নয়।
মেয়েদের প্রতি পুরুষের দৃষ্টি আর আচরণ এক সুতোয় বাঁধা। একটা না পালটালে অন্যটা পালটাবে কী করে? সেই পালটানোর একটা উপায় দু’পক্ষের সহজ সম্পর্ক গড়ে তোলা। এ কাজে দখলদার পুরুষদের এগিয়ে এসে নিজেদের সংশোধন করা চাই। এই ইতিবাচক কথাটা বলা ও ভাবা দরকার। ভাবতে গিয়েই সভাপর্বে পৌঁছে গিয়েছিলাম। ফিরে আসি এ কালে। খেয়াল করে দেখেছি, ছেলে-মেয়েদের মধ্যে ইদানীং গড়ে উঠছে, সহজ গভীর সখ্য। এই সখ্য সব সময় বিয়ের দাবি তোলে না, অধিকারের হিসেব কষে না, কিন্তু পরস্পরের প্রতি গভীর ভালবাসার টান তৈরি করে। মেয়েটি অকপটে সব বলতে পারে ছেলেটিকে। তার পরেও হয়তো কোনও কোনও মুহূর্তে পৌরুষ ফণা তোলে। নিজের পৌরুষের কাছে ছেলেটি হেরে যায়। হয়তো মেয়েটির কাছে চূড়ান্ত বকুনিও খেতে হয়। তার পর আবার চলা, নিজেকে সংশোধন করতে করতে চলা। অধিকার ফলাতে না-চাওয়ার পথে ছেলেটি আর মেয়েটির পাশাপাশি পথ চলা।
সব পুরুষ রাতারাতি বদলে যাব না। কিন্তু চেষ্টা করতে পারি। সেই চেষ্টায় আমাদের সহায় কৃষ্ণ। রতিরসিক, বর্ণময়, রমণীমোহন, আবার নাগরিক, ভদ্র। সখা কৃষ্ণ। |
|
|
|
|
|