দিল্লিতে সাম্প্রতিক গণধর্ষণ লইয়া যে ব্যাপক গণপ্রতিবাদ, তাহাতে রাজনৈতিক দলগুলি হতচকিত। ভারতের সাধারণ মানুষ আপাতদৃষ্টিতে সামাজিক ঘটনাবলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন, কেবল নিজ টেলিভিশন ক্রয় ও ইএমআই শোধ লইয়া ভাবিত। সেই মানুষ দিনের পর দিন পুলিশের উদ্যত জলকামান ও লাঠি অগ্রাহ্য করিয়া স্বতঃস্ফূর্ত দুঃখ ও ঘৃণা লইয়া পথে নামিয়া তাঁহাদের তীব্র মনোবেদনা জানাইবেন, ইহা অপ্রত্যাশিত। যে ঘটনা এই সুশীল সমাজের আশ্চর্য সচেতনতা ও ঐক্য প্রণোদিত করিল, তাহা মর্মান্তিক, অমানবিক। কিন্তু এই লক্ষণটি সমাজের পক্ষে স্বাস্থ্যকর। কোনও রূপ রাজনৈতিক নেতৃত্ব বা ঘোঁট-নির্মাণ ব্যতীত সাধারণ মানুষ একটি চূড়ান্ত আর্তনাদে মিলিত হইতে পারেন, এবং নিজ দাবি সর্বসমক্ষে এমন প্রখর উপস্থিত করিতে পারেন, এই উদাহরণ কর্তৃপক্ষকে শঙ্কিত করিবে, দেশহিতৈষীগণকে আশ্বস্ত করিবে, কারণ ইহাই প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিচায়ক। আক্রান্ত ও ধর্ষিত তরুণীর মৃত্যু হইয়াছে। অনেকে দোষীদের মৃত্যুদণ্ড চাহিতেছেন, কেহ দ্বিধান্বিত। আইন-বিশ্লেষকগণ ইহার ঠিক-ভুল বুঝিবেন, সিদ্ধান্ত লইবেন। কিন্তু ভয়াবহ দণ্ড প্রদান বা চূড়ান্ত ঘৃণা প্রদর্শনের অপেক্ষা সমধিক গুরুত্বপূর্ণ: এই দেশের নেতৃবৃন্দের মানসিকতা পরিবর্তন। তাঁহাদের অনেকাংশের প্রবল অশিক্ষা ও নারীদ্বেষ বিভিন্ন বেফাঁস কথাবার্তায় ও আকার-ইঙ্গিতে এমন জাজ্বল্যমান, ইঁহাদের হস্তে দেশের আইন, পরিস্থিতি, নিরাপত্তা ও প্রসারিত অর্থে জীবন নির্ভর করিতেছে ভাবিলে মুহ্যমান হইতে হয়।
প্রতিবাদ ঘটে ন্যায়বিচারের আশায়। সেই ন্যায়, সেই বিচার বাস্তবে প্রয়োগ করিবার দায়িত্ব যে ব্যবস্থার, তাহা পচনশীল হইলে, সকল সচেতনতাই শেষাবধি ব্যর্থ হইতে বাধ্য। যে খাপ পঞ্চায়েত বলিতেছে ধর্ষণের জন্য মেয়েরাই মূলত দায়ী, ধর্ষণ থামাইতে মেয়েদেরই বাড়ির বাহিরে যাওয়া, সেলফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ করা প্রয়োজন, সেই পঞ্চায়েত কেবল এই দেশে দাপুটে রাজত্বই করিতেছে না, তাহার সমর্থনে একাধিক রাজনৈতিক দল সরব হইতেছে। প্রায় সর্বত্র, ধর্ষণ হওয়া মাত্র কর্তৃপক্ষের কেহ না কেহ নারীটির প্রতিই অভিযোগের আঙুল তুলিতেছেন। জনসমষ্টিকে শিক্ষিত করিবার পরিবর্তে ইঁহারা মূঢ়তায় ঠেলিয়া দেন, কু-বাক্য ও কু-দর্শন ফলাইয়া ভুল পথে চলিতে উত্তেজিত করেন এবং এক একটি দায়িত্বহীন মন্তব্যে প্রগতিকে কয়েক যোজন পিছাইয়া দেন। কেহ বলেন, পার্ক স্ট্রিটের ধর্ষণকাণ্ড এক যৌনকর্মী ও তাঁহার খদ্দেরদিগের ভুল-বোঝাবুঝি মাত্র, কেহ উচ্চ বাংলাজ্ঞান জাহির করিয়া দিল্লি ও কলিকাতার ধর্ষণের ‘প্রেক্ষিত’-এর পার্থক্য নিরূপণ করেন, কেহ ধর্ষিতার স্কার্টের ঝুল মাপিতে এত ব্যস্ত থাকেন যে আত্মশিক্ষা আর হইয়া উঠে না। দিল্লি-ঘটনার অভিঘাত এত পরিমাণে হইবে কেহ বুঝেন নাই, এখন জনক্ষোভ প্রশমনের নিমিত্ত বহু আশ্বাস বর্ষাইতেছে। কিন্তু এই প্রতিবাদ চলাকালীনই এক ধর্ষিতা আত্মহত্যা করিলেন পাটিয়ালায়, তাঁহার অভিযোগ পুলিশ নাকি নথিবদ্ধই করিয়াছিল দুই সপ্তাহ বাদে, দোষীদের তিনি শনাক্ত করা সত্ত্বেও তাহারা ঘুরিতেছিল অবাধে, তাঁহাকে হুমকিও দিতেছিল বারংবার। গত পরশু আলিগড়ে অষ্টম শ্রেণির নাবালিকাকে গণধর্ষণ করিয়া গলার নলি কাটিয়া খুন করিল কিছু দুষ্কৃতী। সকল ঘটনা লইয়া তো বছরভর প্রতিবাদ চলিবে না। দিল্লি-প্রতিবাদ এক প্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিবাদ, তাবৎ নিগৃহীতার হইয়া ইহা কথা বলে, প্রত্যেকের গাঢ় বেদনা লইয়া প্রতিকারের আশায় ফাটিয়া পড়ে। কিন্তু তাহা অনুধাবন করিবার, ক্ষত-নিরাময়ে সচেষ্ট হইবার জন্য যে অনুভূতিপ্রবণ হৃদয় ও সজ্ঞান মস্তিষ্ক প্রয়োজন, এই দেশের নারীবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল গদিসর্বস্ব নেতৃ-নকশায় তাহা কোথায়? যে শিকড়ের মজ্জায় ক্ষয় ও ভ্রান্তিকীট, তাহা হইতে চরম আশাবাদও নবাঙ্কুর স্ফুটিত করিতে পারে কি? |