-


 
জরুরি ছিল কি সিঙ্গাপুরে পাঠানো, বিতর্ক বাড়ল আরও
বিকল হয়ে পড়ছিল বিভিন্ন অঙ্গ, মস্তিষ্কে জল
মাজের কোথায় কতটা কী বিকল হলে জন্ম নেয় এমন এক দামিনী বা নির্ভয়! এ প্রশ্ন নাড়িয়ে দিচ্ছে তাঁদেরও। তবু পেশার তাগিদে তাঁরা শোনালেন শুধু একটি শরীরের মৃত্যুর কথা। “সিভিয়ার মাল্টি-অর্গান ফেলিওর” অর্থাৎ কী না শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ পুরোপুরি বিকল হয়ে এই মৃত্যু।
তেরো দিনের লড়াই। তারই মধ্যে দিন দুই একটু সুস্থ হয়েছিলেন তিনি। নিজেই শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারছিলেন। চিরকুটে অল্প লিখতে পারছিলেন। বলেছিলেন টুকরো টুকরো কথাও। অবাক হয়েছিলেন চিকিৎসকরাও, কী অদম্য মনের জোর! কী অসম্ভব প্রাণশক্তি তেইশের তারুণ্যের! কিন্তু তার পরেই বিকারগ্রস্তদের দাঁত-নখ ফের জোরালো হয়ে বসতে থাকে গভীরে। অন্ত্রে সেপসিস বা পচন শুরু হয়। আবার ভেন্টিলেশনে দিতে হয়। রক্তকণিকা, রক্তচাপ মারাত্মক ভাবে কমে আসছে তখন।
লড়াইয়ের ভার গোটা দেশের হাতে ছেড়ে দিয়ে সে মেয়ে চলে যাওয়ার পরে তাঁর লড়াইয়ের শেষ মুহূর্তগুলির বিবরণ শোনাটা যন্ত্রণার। বলাটাও। তবু দিল্লির সফদরজঙ্গ হাসপাতালের চিকিৎসকদের বলে যেতে হয়, গত মঙ্গলবার হৃদ্যন্ত্রে রক্তের একটি ক্লট (জমাট বাঁধা অংশ) তৈরি হয়। সেটি ফুসফুস পর্যন্ত চলে আসে। এর ফলে প্রায় ৩-৪ মিনিট তাঁর কোনও রক্তচাপ ছিল না। বুধবার কয়েক সেকেন্ডের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায় হৃদ্যন্ত্র। তার পরই তাঁকে এয়ার-অ্যাম্বুল্যান্সে সিঙ্গাপুরে মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সফদরজঙ্গ ও মাউন্ট এলিজাবেথের চিকিৎসকদের মতে, তরুণীর অন্ত্র, যৌনাঙ্গ, তলপেট, ফুসফুস ও মস্তিষ্কে মাত্রাতিরিক্ত সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল। ‘সেরিব্রাল ইডিমা’ বা মস্তিষ্কে জল জমে যাওয়াকেও মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে মনে করা হচ্ছে।
গত বুধবার রাতে দিল্লি থেকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়ার সময় টানা ছ’ঘণ্টা ওই তরুণীর সঙ্গে ছিলেন দিল্লির মেদান্ত মেডিসিটি হাসপাতালের ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশ্যালিস্ট যতীন মেটা। শুক্রবার রাতে তিনি কলকাতায় ফেরেন। গভীর রাতেই মৃত্যুর খবরটা পেয়ে শনিবার সকালে তিনি দিল্লি ফিরে গিয়েছেন। সেখান থেকেই টেলিফোনে জানালেন, তরুণীর অবস্থা চরম সঙ্কটজনক ছিল মঙ্গলবার থেকেই। বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে পড়েছিল, রক্তচাপ প্রায় শূন্যে চলে গিয়েছিল। উন্নততর চিকিৎসার জন্য তাঁকে সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সেখানে পৌঁছেও শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। সংক্রমণ গোটা শরীরে বিশেষ করে মস্তিষ্কে ছড়িয়ে পড়ে। তাঁর শরীর থেকে অনেক রক্ত বার হয়ে গিয়েছিল, অনেক বোতল রক্ত দেওয়াও হয়েছিল। ফলে শরীরে তরলের তারতম্য দেখা দেয়। তার থেকেই মস্তিষ্কে জলের চাপ অত্যন্ত বেড়ে যায়। হৃদ্যন্ত্র মাত্র ২৫-৩০ শতাংশ কাজ করছিল।
প্রতীকী শূন্য কফিন। সামনে রাখা গোলাপের তোড়া। শনিবার দিল্লিতে। ছবি: এ পি
যতীনবাবুর কথায়, “বুধবার সফজরজঙ্গ থেকে আমাকে ও আমাদের হাসপাতালের কার্ডিওভাসকুলার বিশেষজ্ঞ নরেশ ত্রেহানকে ডেকে পাঠানো হয়। আমরা গিয়ে দেখি, তরুণীর অবস্থা সঙ্কটজনক। ৩০ বছরের বেশি চিকিৎসক জীবনে এত ভয়াবহ আঘাত দেখিনি। বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কাজ কমে গিয়েছিল। জ্ঞান নেই। তত দিনে তিনটি বড় অস্ত্রোপচারে ক্ষুদ্রান্ত্রের ৯৫ শতাংশ কেটে বাদ দেওয়া হয়েছিল। তবু অন্ত্র, তলপেট, যৌনাঙ্গে ভয়াবহ সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়েছিল। তখনই সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।”
এয়ার অ্যাম্বুল্যান্সে যতীনবাবু ছাড়াও ছিলেন মেডিসিটি হাসপাতালের দু’জন জুনিয়র ডাক্তার, এক জন নার্স, সফদরজঙ্গের এক জন সিনিয়র চিকিৎসক, ওই মেয়েটির বাবা-মা এবং দুই ভাই।
যতীনবাবু বলেন, “বিমানে মেয়েটির ফুসফুসের অবস্থার বেশ কিছুটা অবনতি হয়। এক সময় রক্তচাপ পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন আর্টেরিয়াল লাইন’ করে রক্তচাপ মনিটরে দেখতে শুরু করি আমরা। প্রথমে তাঁকে ৬০ শতাংশ ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছিল। তা বাড়িয়ে ৭০ শতাংশ করা হয়। এ ছাড়া তিনি মোটামুটি স্থিতিশীল ছিলেন।” তিনি আরও বলেন, “সিঙ্গাপুরে গিয়ে আমরা বুঝতে পারি, যে দিল্লিতে মেয়েটির সিটি স্ক্যান হয়নি। ফলে মাউন্ট এলিজাবেথে গিয়ে প্রথমেই তাঁর পুরো শরীরের স্ক্যান করা হয়। তাঁকে সর্বোচ্চ ভেন্টিলেশন এবং অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে রাখা হয়। ওখানকার চিকিৎসকদের সঙ্গে আমাদের ৩টি দীর্ঘ বৈঠকও হয়েছিল। ঠিক হয়েছিল, অবস্থা একটু স্থিতিশীল হলে তাঁর অন্ত্র প্রতিস্থাপন করা হবে। কিন্তু ওঁর শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও মস্তিষ্কের সংক্রমণ এত তীব্র ছিল যে শেষরক্ষা হল না।”
লড়াই থেমে গেল চিকিৎসকেদের। কিন্তু তাতেই শুরু হয়েছে এক অন্য বিতর্ক। চিকিৎসকদের নিজেদের মধ্যেই। এতটা সঙ্কটজনক অবস্থায় কোনও রোগীকে সিঙ্গাপুরে কেন পাঠাতে হল? দিল্লির গঙ্গারাম হাসপাতালের সার্জিক্যাল গ্যাসট্রোএন্টেরোলজি অ্যান্ড লিভার ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের চিকিৎসক সমীরণ নন্দীর বক্তব্য, দিল্লিতে ওই একই মানের একাধিক হাসপাতাল ছিল।” বিজেপি-র সাংসদ মেনকা গাঁধী-সহ বিরোধী পক্ষের কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, এইম্স বা সফদরজঙ্গের মতো দেশের প্রথম সারির হাসপাতালেও কি এই ধরনের চিকিৎসার যথাযথ পরিকাঠামো নেই? সফদরজঙ্গ হাসপাতালের অ্যাডিশন্যাল মেডিক্যাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট তাপস ভৌমিক কিন্তু বলছেন, “আমাদের হাসপাতালে মেয়েটির ঠিকঠাক চিকিৎসাই হচ্ছিল। পরিকাঠামোরও কোনও অভাব নেই আমাদের। বিশ্বমানের চিকিৎসার সঙ্গে আমরা পাল্লা দিই। সিঙ্গাপুরে পাঠানোর পুরো সিদ্ধান্তটাই রাজনৈতিক। দিল্লিতে মেয়েটি মারা গেলে সামগ্রিক ভাবে বিক্ষোভ, অস্থিরতা তৈরি হতে পারে, সেই আশঙ্কাতেই এটা সরকারি সিদ্ধান্ত।”
ওই হাসপাতালের সদ্য-প্রাক্তন অ্যাডিশন্যাল মেডিক্যাল সুপার সুজিত কুমার দাসেরও বক্তব্য, “সিঙ্গাপুরে নিয়ে গিয়ে কতটা ভাল হল, এ নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মেয়েটির শারীরিক অবস্থা এত খারাপ ছিল যে, তখন কিছুতেই অন্ত্র প্রতিস্থাপন করা যেত না। তা হলে কেন এত দূর উজিয়ে নিয়ে যাওয়া?”
চিকিৎসক যতীন মেটার অবশ্য দাবি, “পরে সমালোচনা করা সব থেকে সহজ। মেয়েটি বিমানের মধ্যে মারা গেলে আমাদের আরও বেশি কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হত। কিন্তু মনে রাখবেন, সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার পরেও তিনি ৪৮ ঘণ্টা বেঁচে ছিলেন।” পরিকাঠামোর প্রশ্নে যতীনবাবুর বক্তব্য, “সফদরজঙ্গের থেকে সিঙ্গাপুরের ওই হাসপাতালে পরিকাঠামো অনেকাংশে উন্নত। তবে এইম্সের কথা তাঁর জানা নেই।” সফদরজঙ্গের মেডিক্যাল সুপার বদ্রীনাথ আথানিও বলেন, “মেয়েটির অবস্থা ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। আমরা চেয়েছিলাম যাতে উনি সর্বোচ্চ চিকিৎসা পান। সেটা এইমস বা সফদরজঙ্গে পাওয়া যেত না। ভারতের সব চেয়ে কাছে সিঙ্গাপুরেই ওই পরিকাঠামো পাওয়া যাচ্ছিল। তাই ওখানে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।” তবে তিনি এ-ও স্বীকার করেন যে, “সিঙ্গাপুরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত শুধু চিকিৎসকদের নয়। সরকারের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল এতে।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.