|
|
|
|
তফাত যাও রাজনীতি, বার্তা দিল যন্তর-মন্তর |
দিগন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় • নয়াদিল্লি |
এক সপ্তাহ আগেও জীবন-যুদ্ধ চলছিল। দিল্লি তখন রাগে ফুঁসছিল।
মেয়েটির যুদ্ধ থেমে গিয়েছে কাল রাতেই। আজ সকাল থেকে দিল্লি কান্নায় ভেঙে পড়েছে।
ক্ষোভ আছে। রোষ আছে। উষ্মা আছে। প্রতিবাদ আছে। কিন্তু সে সবই শোকের কুয়াশায় মোড়া।
কাল সন্ধেতেই প্রশাসনের কাছে খবর এসে গিয়েছিল সিঙ্গাপুর থেকে আশা আর নেই। তখনই তড়িঘড়ি বৈঠকে বসে দিল্লি পুলিশ। মৃত্যুর ঘোষণা হলে ফের অগ্নিগর্ভ হতে পারে রাজধানী, প্রমাদ গুনছিল সরকার। সব পুলিশের শনিবারের ছুটি বাতিল করে দেওয়া হয়। রাতেই সিদ্ধান্ত হয়, ফের বন্ধ রাখা হবে দিল্লির প্রাণকেন্দ্র। বন্ধ রাখা হবে ইন্ডিয়া গেট থেকে রাইসিনা হিলের যাবতীয় পথ। বন্ধ থাকবে আশপাশের দশটি মেট্রো স্টেশন। গোটা দিল্লিতে জারি করা হবে ১৪৪ ধারা।
কিন্তু বাদ সাধলেন শীলা দীক্ষিত। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী ফোন করলেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীল কুমার শিন্দেকে। বললেন, মানুষকে ক্ষোভ প্রকাশ করারও জায়গা দিতে হবে। যন্তর-মন্তর আর রামলীলা খুলে দেওয়া হোক।
সকাল থেকেই শোকার্ত জনতার ঢল নামতে শুরু করল যন্তর-মন্তরে। দুপুরে এলেন শীলা দীক্ষিত নিজেও। শোকের শরিক হতে। বাহাদুর মেয়ের স্মৃতিতে মোমবাতি জ্বালাতে। তত ক্ষণ অবধি শান্তই ছিল ভিড়। কিন্তু শীলা আসামাত্র ছড়িয়ে পড়ল উত্তেজনা। এ শহর শোকের মুহূর্তে কোনও রাজনীতি চায় না। স্লোগান উঠল, ‘শীলা দীক্ষিত হায় হায়!’ ‘শীলা দীক্ষিত বাপস যাও’। কোনও রকমে ভিড়ের সঙ্গে পাঞ্জা কষে মুখ্যমন্ত্রীকে নিরাপদে বাইরে নিয়ে গেল পুলিশ। ফের স্লোগান, ‘নারী শক্তি জাগ গ্যয়ি, শীলা দীক্ষিত ভাগ গ্যয়ি’...। |
|
ভিড় থেকে শীলাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাচ্ছে পুলিশ। শনিবার দিল্লির যন্তর-মন্তরে। |
শীলার বক্তব্য ছিল, তিনি রাজনীতি করতে যাননি। শুধু শোক জানাতেই গিয়েছিলেন। শহর তা শুনবে কেন? তার তো মনে আছে, “প্রতিবাদ যখন শুরু হয়েছিল, তখন শীলা কোথায় ছিলেন?” এক প্রতিবাদী আরও মনে করালেন, “যখন শীলার বাড়ির সামনে বিক্ষোভ দেখানো হয়েছিল, তখন উনি পুলিশ দিয়ে তাদের সরিয়ে দিয়েছিলেন!” এখন কোনও নেতানেত্রীকে নিজের যন্ত্রণার শরিক করতে রাজি নয় দিল্লি।
জনতার আজ স্পষ্ট বার্তা যে মেয়েটি প্রাণ দিলেন, তিনি দামিনীই হোন বা আমানত বা নির্ভয়, তিনি এ শহরের মেয়ে। গোটা দেশের মেয়ে। তিনি আজ ঘুমোলেন। বাকিদের এখন জাগার পালা। যন্তর-মন্তরে রাজনৈতিক পতাকা নিয়ে যাঁরাই আসছেন, ভিড় ফেরত পাঠাচ্ছে তাঁদের। বলছে, এটি শোকস্থল, রাজনীতির নয়। সামনেই ফুল দিয়ে মোড়া একটি ছোট্ট ফটোফ্রেম। তাতে লেখা দামিনী। তার মুখের দিকে তাকিয়েই চোয়াল আরও শক্ত হচ্ছে। দাবি উঠছে, এই যন্তর-মন্তরেই প্রকাশ্যে ফাঁসি হোক ধর্ষকদের। আজ কালো শনিবার। আজকের দিনটা পালন হোক ‘জাতীয় লজ্জা দিবস’ হিসাবে। আর রবিবার হোক ভারত-বন্ধ। আজ যদি সরকার পথঘাট-মেট্রো বন্ধ রাখতে পারে, কাল জনতা ভারত বন্ধ করুক। ধ্বনি ভোটে সে প্রস্তাব পাশও হয়ে গেল রাস্তার ‘সংসদে’। কাঁদানে গ্যাস, জলকামান নিয়ে সশস্ত্র পুলিশ সে দিকে তাক করে রইল। |
|
প্রতিবাদীদের শ্রদ্ধাজ্ঞাপন। শনিবার যন্তর-মন্তরে। |
নতুন দল গড়া অরবিন্দ কেজরিওয়াল বসে থাকলেন। রাজনীতির বুলি আওড়ানোর সুযোগ পেলেন না। বৃন্দা কারাটরা আলাদা করে মিছিল করলেন। সন্ধেয় পুলিশের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে যন্তর-মন্তর থেকে পার্লামেন্ট স্ট্রিট ধরে মানুষের নিজস্ব মিছিল আবার যন্তর-মন্তরে ফিরে এল। বেলা গড়ানোর পরে এত দিনে মাঠে নামতে দেখা গেল স্থানীয় বিজেপি নেতাদের। তাঁদেরই পরামর্শে মোমবাতি মিছিলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে মন্ত্র-উচ্চারণকারী মশালধারীরা। মোমবাতি সরে দাঁড়িয়েছে। মশালের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখেছে। সন্ধে যত গড়িয়েছে, যন্তর-মন্তরে উপছে পড়েছে ভিড়। জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি শান্তি মিছিল বেরিয়েছে মুনিরকা পর্যন্ত। মুনিরকা-ই সেই জায়গা, যেখান থেকে তেইশ বছরের জমে থাকা স্বপ্ন নিয়ে বন্ধুর সঙ্গে বাসে উঠেছিলেন মেয়েটি। ৩১শে, বর্ষশেষের রাত ওই মুনিরকার বাসস্টপেই পালন করবেন ছাত্রছাত্রীরা। এই উদ্যাপনের নাম ওঁরা দিচ্ছেন, ‘রাত কো কব্জা’ করার লড়াই বলে।
লড়াকু মেয়েটির না-বলা কথাগুলোই আজ সমস্বরে বলছে বিহ্বল জনতা। যন্তর-মন্তরে প্রার্থনা চলছে। তার মাঝেই ঢোলক হাতে বৃন্দগান...
এই মেয়েটি ঘরে চাইত? ‘আজাদি’
বাসে চাইত? ‘আজাদি’
পুলিশের থেকে? ‘আজাদি’
সরকারের থেকে? ‘আজাদি’
‘আজাদ’ মেয়েটি যদি শুনতেন! |
ছবি: পিটিআই |
|
|
|
|
|