বাঁচার লড়াই
সাঙ্গ তাঁর
মায়ের কাছে তিনি বলেছিলেন, ম্যায় জিনা চাহতি হুঁ। সেই বাঁচার ইচ্ছের সঙ্গে ছিল সাহস ও মনের জোর।
এই নিয়ে ১৩ দিন।
এই ১৩ দিনে মৃত্যুর সঙ্গে এক অসম লড়াইয়ের সাক্ষী থেকেছে গোটা দেশ। এই ১৩টা দিন দেখল, সমস্ত শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করেও বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছে কী ভাবে চালু রাখে শ্বাস-প্রশ্বাস। গণধর্ষণ ও লোহার রডের আঘাত শরীরে নিয়েও কী ভাবে দাঁতে দাঁত চেপে অপরাধীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য পুলিশের সামনে দু’বার বয়ান দেওয়া যায়। একের পর এক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ যখন কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছে, তখনও কী ভাবে অপারেশন থিয়েটারে ঢোকার আগে মায়ের হাত ধরে বলতে পারা যায়, আমি বাঁচতে চাই।
সেই ১৩ দিন। যখন বদলে গিয়েছে রাজধানীর চেহারা। ইন্ডিয়া গেট-বিজয় চক চত্বরও যে তাহরির স্কোয়ার হয়ে উঠতে পারে, তার সাক্ষী থেকেছে নয়াদিল্লি। কোনও রাজনৈতিক আন্দোলন নয়। সংসদের অচলাবস্থা নয়। পথ অবরোধ-বন্ধ-ধর্মঘট নয়। এই ১৩ দিনেই যৌননিগ্রহের মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য দিল্লিতেই পাঁচটি বিশেষ আদালত চালুর ব্যবস্থা হয়েছে। ফৌজদারি আইন খতিয়ে দেখতে তৈরি হয়েছে বিশেষ কমিটি। তারা কাজ শুরু করে দিয়েছে। রাজধানীতে মহিলাদের নিরাপত্তা জোরদার করতে কিছু পদক্ষেপ করেছে দিল্লি পুলিশ।
এই সবই তাঁর জন্য।
রাস্তায় নেমে হাজার হাজার মানুষ বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। মৃত্যুর সঙ্গে সে একলা লড়াই চালিয়ে গিয়েছে। যে লড়াইটা প্রথম থেকেই অসম ছিল। ফুসফুসে, রক্তে সংক্রমণ, ক্ষতবিক্ষত হয়ে যাওয়া অন্ত্র, মস্তিষ্কে আঘাত সব মিলিয়ে চিকিৎসকরাও তাঁর মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার বিষয়ে খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না। তা সত্ত্বেও মেয়েটির বাঁচার ইচ্ছা দেখে তাঁরা বিস্মিত হয়েছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। শুক্রবার ভারতীয় সময় রাত সওয়া দু’টোয় মৃত্যু হয় মেয়েটির। ২৩ বছরের প্যারামেডিক্যাল ছাত্রীর। সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালের প্রধান কেলভিন লোহ্ জানান, “এত দিন সব প্রতিকূলতার সঙ্গে সাহসের সঙ্গে লড়াই করেছিল মেয়েটি। কিন্তু শরীরের নিদারুণ যন্ত্রণা এতটাই বেশি ছিল যে, তা কাটিয়ে ওঠা তাঁর পক্ষেও সম্ভব হয়নি।”
ভোররাতে মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই গোটা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। দিল্লি-সহ সমস্ত শহরে প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নামেন সাধারণ মানুষ। তবে তা ছিল শান্তিপূর্ণ। মোমবাতি হাতে নীরব প্রতিবাদে সংযম শোকের আবহকে নষ্ট হতে দেয়নি।
সরকারের অবশ্য আশঙ্কা ছিলই। সে জন্য শহরের সর্বত্র ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় ১০টি মেট্রো স্টেশন। আটকে দেওয়া হয় ইন্ডিয়া গেট থেকে রাইসিনা হিলের সব পথ। শেষ পর্যন্ত দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিতের কথায় যন্তরমন্তর ও রামলীলা ময়দান খুলে দেওয়া হয়। কিন্তু সেই শীলাকেই যন্তরমন্তরে এসে পড়তে হয় বিক্ষোভের মুখে। সন্ধ্যায় সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ৭ রেসকোর্স রোডে বৈঠকে বসেন কংগ্রেস নেতৃত্ব। সেখানে সনিয়া গাঁধীও ছিলেন। মহারাষ্ট্র-সফর কাটছাঁট করে ফিরে বৈঠকে যোগ দেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুশীলকুমার শিন্দেও। এর মধ্যে ঘটনায় অভিযুক্ত ছ’জনের (যাদের আগেই গ্রেফতার করা হয়েছে) বিরুদ্ধে গণধর্ষণ, প্রমাণ লোপ, ডাকাতির অভিযোগের পাশাপাশি ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় খুনের মামলাও দায়ের করা হয়েছে। দিল্লি পুলিশের স্পেশ্যাল কমিশনার (আইন-শৃঙ্খলা) ধর্মেন্দ্র কুমার জানিয়েছেন, এই আইনে সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড)-এর জন্যই তাঁরা আদালতে দাবি জানাবেন। প্রতিদিন শুনানি হবে। সরকারের পক্ষ থেকে বিশিষ্ট আইনজীবী নিয়োগ করা হবে। পুলিশের আশা, আগামী ৩ জানুয়ারির মধ্যেই চার্জশিট পেশ করা সম্ভব হবে।

আমার যন্ত্রণা হচ্ছে যে, আমি এমন একটা সমাজ ও সংস্কৃতির অংশ। আমার যন্ত্রণা হচ্ছে যে, আমি এক জন পুরুষ। আমি প্রতিজ্ঞা করছি, আমার প্রতিবাদের কণ্ঠ হবে তুমিই। আমি নারীকে সম্মান করব, যাতে বাবা হিসেবে মেয়ের শ্রদ্ধা অর্জন করতে পারি।
শাহরুখ খান
সাহসী মেয়েটি নিজের সম্মান ও জীবনের জন্য শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই চালিয়েছিলেন। উনি ভারতের সাহসী মেয়ে, প্রকৃতই হিরো।
প্রণব মুখোপাধ্যায়
এই ঘটনাকে ঘিরে কতটা আবেগ তৈরি হয়েছে, তা আমরা দেখেছি।.....সমাজের মানসিকতায় পরিবর্তন নিয়ে বিতর্ক প্রয়োজন।
মনমোহন সিংহ
আমরা শপথ নিচ্ছি, মেয়েটি বিচার পাবেন। তাঁর লড়াই বিফলে যাবে না। সকলেরই মনে হচ্ছে তাঁর মেয়ে বা বোন মারা গিয়েছেন।
সনিয়া গাঁধী
যারা কাজটা করেছে, জানি না তারা মানুষ কি না। ওদের কঠোরতম শাস্তি হওয়া উচিত।
সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়
সময় চলতে মোমবাতিয়াঁ, জ্বল কর বুঝ জায়েগি...
শ্রদ্ধা মে ডালে পুষ্প, জল হীন মুর্ঝা জায়েঙ্গে...
স্বর বিরোধকে অওর শান্তিকে আপনি প্রবলতা খো দেঙ্গে...
কিন্তু ‘নির্ভয়তা’ কি জ্বলাই অগ্নি হামারে হৃদয়কো প্রজ্জ্বলিত করেগি...
জল হীন মুর্ঝায়ে পুষ্প কো হামারি অশ্রু ধারায়ে জীবিত রাখেগি...
দগ্ধ কণ্ঠ সে ‘দামিনী’ কি ‘আমানত’ আত্মা বিশ্বভরমে গুঞ্জেগি...
স্বর মেরে তুম, দল কুচল কর পিস না পাওগে
ম্যায় ভারত কি মা বহনিয়া বেটি হুঁ,
আদর অওর সৎকার কি ম্যায় হকদার হুঁ...
ভারত দেশ হামারি মাতা হ্যায়,
মেরি ছোড়ো, আপনি মাতা কি তো পহচান বনো!!
অমিতাভ বচ্চন

শুধু আইনশৃঙ্খলাই নয়, রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও কংগ্রেসের শীর্ষ বৈঠকে আলোচনা হয়। এই ১৩ দিন ধরে যেমন আমজনতার প্রতিবাদে উত্তাল হয়েছে রাজধানী, তেমনই তাকে কাজে লাগিয়ে ফায়দা তুলতে চেয়েছে বিরোধীরা। দাবি উঠেছে সংসদের বিশেষ অধিবেশন ডাকার। তা না হলেও প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি দিয়েছেন। সনিয়া গাঁধী বিক্ষোভকারী ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলেছেন।
গত কাল কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা দিবসেও তিনি মেয়েটির জন্য প্রার্থনা করেছিলেন। আজও কান্নাভেজা চোখে সনিয়া বলেছেন, “আমরা শপথ নিচ্ছি, মেয়েটি বিচার পাবে। তাঁর লড়াই বিফলে যাবে না। যাঁরা নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন, যাঁরা ওঁর সমর্থনে রাস্তায় নেমেছেন, আমি তাঁদের আশ্বস্ত করছি, আপনাদের কথা আমরা শুনেছি। এক জন মহিলা হিসেবে, মা হিসেবে আপনাদের অনুভূতি আমি বুঝি।”
এ দিন বিবৃতি দিয়েছেন রাহুল গাঁধীও। তিনি বলেছেন, “আমি আমার মা এবং বোনের সঙ্গে ওই তরুণীর পরিবারের প্রতি গভীর শোক জানাচ্ছি। তাঁদের জন্য প্রার্থনা করছি।” তবে প্রশ্ন উঠেছে, কংগ্রেসে নতুন প্রজন্মের প্রতিনিধি রাহুল গাঁধী কি মুখ খুলতে বেশি দেরি করলেন না? তিনি তো তাঁর মায়ের মতো এমন কিছুও বললেন না, যা মনে দাগ কেটে দেয়।
রাজনীতির প্রসঙ্গ এসেছে তরুণীকে সিঙ্গাপুর নিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গেও। আদৌ তার প্রয়োজন ছিল কি না, তা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিতর্ক শুরু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, চিকিৎসকদের থেকেও রাজনীতিকদের ইচ্ছেটাই সেখানে বড় হয়ে উঠেছিল কি না।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শিন্দে অবশ্য যুক্তি দিয়েছেন, সরকারের একমাত্র নজর ছিল মেয়েটির জন্য সর্বোচ্চ মানের চিকিৎসার বন্দোবস্ত করা। চিকিৎসকদের সঙ্গে পরামর্শ করে, সব দিক খতিয়ে দেখেই সিঙ্গাপুরে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। সিঙ্গাপুরের হাসপাতালের তরফেও জানানো হয়েছে, আট জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তাঁকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন।
উত্তরপ্রদেশের গ্রামে এক টুকরো জমি বেচে বাবা-মা তাঁকে দিল্লিতে ফিজিওথেরাপির প্রশিক্ষণ নিতে পাঠিয়েছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর রাতে এক বন্ধুর সঙ্গে সিনেমা দেখে ফেরার সময় চলন্ত বাসের মধ্যে গণধর্ষণ ও অত্যাচারের শিকার হন ওই তরুণী। সেই দিন থেকেই লড়াই শুরু। তার পরে যে এই ১৩ দিন, তাতেও কি দেশে নারী-নিগ্রহের ছবিটা কি পাল্টেছে?
তথ্য বলছে, একেবারেই না। ১৬ ডিসেম্বরের পরেও গোটা দেশ জুড়ে ধর্ষণকারীদের ফাঁসিতে ঝোলানোর দাবি উঠেছে। কিন্তু তার মধ্যেও বিভিন্ন শহরে নারী-নিগ্রহের ঘটনা অব্যাহত। খোদ দিল্লিতেই আরও কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। আজ প্রধানমন্ত্রী তাই বলেছেন, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলের প্রয়োজন।
প্রশ্ন হল, ‘আমানত’ বা ‘নির্ভয়’ বা ‘দামিনী’, ওই অনামা মেয়েটি, যিনি আজ সারা দেশের শোকের প্রতীক, প্রতিবাদের প্রতীক, নিজের জীবন দিয়ে কি সেই দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে পারবেন?


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.