অনেক মুখ। অনেক স্বর। অনেক পতাকা। একটি শোকাবহ মৃত্যুই যেন মিলিয়ে দিয়েছে সবাইকে।
বছর শেষের সপ্তাহান্তেও শহরের প্রাণকেন্দ্রে হাতে হাতে জ্বলল মোমবাতি। ধর্মতলা থেকে হাজরা মোড় বা বিড়লা তারামণ্ডলের দিকে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলল মিছিল। স্কট লেন, পার্ক স্ট্রিট মোড় বা নিউ আলিপুর-বেহালার পাড়ার জমায়েত প্রতিবাদে সামিল হল নিজের মতো করে।
শনিবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে বিরোধী বাম শিবিরের নেতা বিমান বসু যখন ধর্ষণকারীর ‘কঠোরতম শাস্তির প্রয়োজনীয়তা’র কথা বলছেন, শহরের নাগরিক-সমাজ তখন ধর্ষণ মোকাবিলার রাজনৈতিক সদিচ্ছা নিয়েই প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে। দিল্লির সঙ্গে পার্ক স্ট্রিট, বেঙ্গালুরু বা ত্রিপুরায় মেয়েদের উপরে নির্যাতনের প্রতিবাদও এক বন্ধনীতে ধরা পড়েছে। নিছক ধর্ষণকারীর শাস্তি বা মৃত্যুদণ্ডের দাবি নয়, ধর্ষণের নেপথ্যে পীড়নকারী নৃশংস মনটারও মৃত্যু চেয়েছে কলকাতা।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকস্তরের ছাত্র নির্ঝর মুখোপাধ্যায় বা হাবড়ার কলেজ থেকে সদ্য স্নাতক যুবা রুদ্রদীপ চন্দ যেমন বলছিলেন, ধর্ষণকারীর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হলেই কাজের কাজ হবে না। দ্রুত তদন্ত ও পুলিশ-প্রশাসনের সংবেদনশীলতা ঢের জরুরি। নির্ঝরের কথায়, “আমি শুধু একটি মেয়ের মৃত্যুর প্রতিবাদে পথে নামিনি। পুরুষতন্ত্রের যে সব মূল্যবোধ একটি মেয়ের উপর হামলায় ইন্ধন জোগায়, তার প্রতিবাদ করতে এসেছি।” দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে এম-ফিলের ছাত্রী শ্রিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়, “দিল্লির ধর্ষণ তো বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীও তো ধর্ষণকে দমনের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকে। সে সব-কিছুরও প্রতিবাদ করছি আমরা।”
প্রতিবাদের স্বর শুধুমাত্র ধর্ষণের ঘটনার বিরুদ্ধে গর্জে উঠেই শান্ত হয়নি। মানিকতলার এক প্রবীণ দম্পতি অঞ্জন ও বাণী চট্টোপাধ্যায় বলছিলেন, ধর্ষণের পরে ধর্ষিতার চরিত্র কাটাছেঁড়া করে আলটপকা মন্তব্যও এ বার বন্ধ হোক। |
ধর্ষণের পরে ক্ষতিপূরণের মূল্য নির্ধারণে ঘোর আপত্তি প্রাক্তন নকশাল নেতা অসীম চট্টোপাধ্যায় বা সমাজকর্মী অসীম গিরিদের। সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের শিক্ষক অনন্যা চক্রবর্তী কলকাতা তথা দেশজুড়ে প্রতিবাদে আশার আলো দেখছেন। সত্তরের দশকে মহারাষ্ট্রে মথুরা ধর্ষণ-মামলার জেরে এ দেশের ধর্ষণ-বিরোধী আইন ঢেলে সাজা হয়েছিল। ছলে-বলে বা ভয় দেখিয়ে ধর্ষণের সংজ্ঞা নিরুপণেও প্রভাব ফেলেছিল ওই মামলা। অনন্যার আশা, দিল্লির এই ঘটনাটিও হয়তো সূদূরপ্রসারী ছাপ রেখে যাবে। “অন্তত ধর্ষণের দ্রুত বিচারে ফাস্ট ট্র্যাক গঠনের মতো কিছু প্রশাসনিক পদক্ষেপ এ বার দেখা যেতে পারে,”— বলছিলেন তিনি। যৌনশিক্ষায় ঘাটতি বা চলচ্চিত্র-বিজ্ঞাপনে নারীর পণ্যায়ন নিয়ে নানা প্রশ্নও প্রতিবাদীদের জমায়েতে উঠে এসেছে।
১৭ বছরের তরুণীর মা দক্ষিণ কলকাতার শবনম মির্জা বা এক কন্যার পিতা বিরাটির অবসরপ্রাপ্ত কুমার চক্রবর্তী অবশ্য এখনই অত-শত ভাবতে পারছেন না। শবনম বলছেন, “আমিও মেয়ের মা, তাই এসেছি।” আর কুমারবাবুর মনে পড়ে গিয়েছে, এক যুগ আগে নয়াদিল্লি স্টেশনেই তাঁর নিজের মেয়ের হয়রানির একটি ঘটনা। তাঁর মেয়েও ঝাঁসিতে ডাক্তারি পড়ত। “এক বার নয়াদিল্লি স্টেশনে ওকে বেশ কিছু ক্ষণ একলা দাঁড়িয়ে আমাদের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। চার পাশের হিংস্র লোলুপ চোখের আনাগোণা দেখে ও ভয়ে একেবারে সিঁটিয়ে যায়। তখনই মনে হয়েছিল, এ কোন সমাজে বাস করি আমরা।”—বললেন কুমারবাবু। আম-নাগরিকের ক্ষোভ ও আবেগের শরিক হতে চেষ্টার কসুর করেনি মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলিও। দুপুরে বামফ্রন্টের কলকাতা জেলা কমিটি, এসইউসিআই-এর মিছিলের পরে সন্ধ্যায় দক্ষিণ কলকাতায় কংগ্রেসের মিছিল দেখা গিয়েছে। এফডিআই-এর হয়ে সওয়াল করতে রানি রাসমণি অ্যাভিনিউয়ে কংগ্রেসের সভাও শোক-সভার চেহারা নেয়। মাঠে নেমেছিল এপিডিআর-ও। শহর ক্ষোভে ফুটছে, এই আবহে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের ঘটনায় বাড়তি গুরুত্ব দিতে থানাগুলিকে সতর্ক করে দিয়েছেন পুলিশ কমিশনার রঞ্জিত পচনন্দা। বর্ষবরণের রাতে অপ্রীতিকর ঘটনা ঠেকানো নিয়েও লালবাজারের ক্রাইম কনফারেন্সে দীর্ঘ আলোচনা হয়। বছর শেষের রাতে উৎসবে সামিল না-হওয়ার কথা ফেসবুকে লিখেছেন কেউ কেউ। ছুটির দিনের শহরের রাজপথের কয়েকটি বিক্ষিপ্ত দৃশ্যও কলকাতার সহমর্মিতার ছবিই তুলে ধরল। |