মুখ্যমন্ত্রীর কোচবিহার ও জলপাইগুড়ি সফরে দু’দিনে চার হাজার কিষান ক্রেডিট কার্ড (কেসিসি) বিলি হল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৃষকেরা তাতে কতটা উপকৃত হবেন, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ইদানীং ব্যাঙ্কের কড়াকড়িতে এই দুই জেলাতে প্রায় অর্ধেক চাষি কেসিসি থাকা সত্ত্বেও ঋণ পাননি। এখনও মহাজনের ভরসায় চাষবাস করছেন দুই জেলার অন্তত লক্ষাধিক চাষি। মুখ্যমন্ত্রী কোচবিহারে বলেছেন, “আমি শুনেছি, কার্ড থাকলেও ঋণ দেওয়া নিয়ে কিছু ব্যাঙ্ক ঘোরাচ্ছে। ঋণ পেতে যাতে হয়রানি না-হয় তা প্রশাসনিক অফিসারদের বলেছি।”
প্রশাসনিক সূত্রের খবর, এই দুই জেলাতেই ঋণ নিয়ে তা শোধ না করার প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে বলেই ব্যাঙ্ক হালে কড়াকড়ি বাড়িয়েছে। একাধিক ব্যাঙ্কের দেওয়া আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী, দুই জেলায় নথিভুক্ত ৪ লক্ষাধিক চাষির মধ্যে অন্তত ২০ শতাংশ ঋণ শোধ দেননি। যাঁদের মধ্যে অর্ধেক ঋণের কিস্তি দেওয়ার চেষ্টা করছেন। বাকিরা শোধ দেওয়া সম্ভব নয় বলে ঋণদাতা সংস্থাগুলিকে জানিয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গিয়েছে, আগে তবুও নানা ভাবে চাপ দিয়ে ঋণ শোধ করানোর চেষ্টা করা যেত। কিন্তু, পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকে সমবায়ের তরফে ঋণখেলাপিদের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেওয়ার পরে খোদ মুখ্যমন্ত্রীই অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন। কয়েকজন ব্যাঙ্ক অফিসার জানান, তারপর থেকেই এই ধারণা ছড়িয়ে পড়ে যে, ঋণ শোধ না-দিলেও চাষির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না। তাতেই বাড়তি কড়াকড়িও শুরু হয়েছে। |
নাগরাকাটার অনুষ্ঠানে। ছবি: দীপঙ্কর ঘটক। |
তাতে সমস্যায় পড়েছেন ডুয়ার্সের ফালাকাটা ব্লকের গুয়াবরনগর গ্রাম পঞ্চায়েতের বাসিন্দা কৃষক ধীরেন বর্মনের মতো বহু কৃষিজীবী। ধীরেনবাবুর তিন বিঘা জমি। ধান ও আলু ফলিয়ে সংসার চালান। তিনি বলেন, “কেসিসি পাওয়ার পরে ঋণ পেতে জুতোর সুকতলা ক্ষয়ে যাওয়ার জোগাড়। তাই চেনাজানা মহাজনের থেকে একটু বেশি সুদে হলেও টাকা নিয়ে চাষ করছি।” একই ভাবে ধূপগুড়ির বেগুনচাষি ক্ষীরোদ রায় কিংবা হলদিবাড়ি টম্যাটো চাষি সুধীর মণ্ডলরা জানান, ছ’মাস আগে কেসিসি পেলেও আজও ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ পাননি তাঁরা।
এই অবস্থায় কেসিসি’র সাহায্যে চাষিদের ‘মহাজনের সুদের চক্র’ থেকে বের করে আনা সহজ নয় বলে মনে করেন সব দলের কৃষক নেতারাই। কংগ্রেসের কোচবিহারের কৃষক নেতা শৈলেন বর্মা কিংবা তৃণমূলের কৃষক সংগঠনের কবির আলি অথবা ফরওয়ার্ড ব্লকের অগ্রগামী কিষাণ জেলা সম্পাদক দীপক সরকারসকলেই কার্ড বিলির পরে ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করার দাবিতে সরব হয়েছেন।
কৃষক সংগঠনগুলি সূত্রে জানা গিয়েছে, কেসিসি পাওয়া তেমন শক্ত নয়। কৃষি দফতর সূত্র থেকে জানা গিয়েছে, ২০০২ থেকে এখনও পর্যন্ত কোচবিহারে প্রায় ২ লক্ষ ২৭ হাজার কেসিসি বিলি হয়েছে, যার মধ্যে বাম-আমলে কার্ড পান ১ লাখ ১০ হাজার কৃষক। এই জেলায় কেসিসি পাওয়ার যোগ্য প্রায় ২ লাখ ৯০ হাজার কৃষক। অর্থাৎ, তার মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশই এই কার্ড পেয়ে গিয়েছেন। জলপাইগুড়ি কৃষি দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই জেলায় নথিভুক্ত চাষির সংখ্যা ৩ লক্ষের বেশি। তাঁদের অর্ধেকের বেশি কেসিসি পেয়েছেন বলে কৃষি দফতরের একটি সূত্রে দাবি করা হয়েছে। কিন্তু, কার্ড পেলেও ব্যাঙ্ক ঋণ পাননি এমন চাষির সংখ্যা এই জেলায় অন্তত ৫০ হাজার বলে কৃষক নেতাদের দাবি।
তাই ময়নাগুড়ির সম্পন্ন চাষি শিরেন রায় বলেন, “শুধু কেসিসি দিলেই সরকারের দায়িত্ব শেষ হয় না। ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করতে সরকারকে তদারকি করতে হবে। চাষিরা ঋণ পাওয়ার পরে ফসল ফলিয়ে যাতে দাম পান সেটাও দেখতে হবে। না হলে মহাজনের দুষ্টচক্রের জাল ছেঁড়া যাবে না।” তাঁর দাবি, সরকার চাষিদের হাল-হকিকত সম্পর্কে বিশদে তথ্যপঞ্জী তৈরি করুক।
জলপাইগুড়ি কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাঙ্কের চেয়ারম্যান সৌরভ চক্রবর্তী বলেন, “বাম আমলে কেসিসি বিলি করেই দায় সারা হয়েছে। অন্য ব্যাঙ্কের কথা বলতে পারব না। আমরা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে জলপাইগুড়ি, কোচবিহার এবং শিলিগুড়ির কৃষকদের মধ্যে ৫৪ কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। চাষবাস এবং চাষিদের যাবতীয় তথ্য নিয়ে একটি ডেটা-ব্যাঙ্ক তৈরি হচ্ছে। ইতিমধ্যেই চাষিদের জন্য হেল্পলাইনও চালু করেছি।” |