মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী ঘোষণা করে দিয়েছেন, অতএব স্বাস্থ্য দফতর জানে, রাজ্যের অনুন্নত এলাকায় আগামী দু’বছরের মধ্যে তাদের ১৩টা মাল্টি-স্পেশ্যালিটি ও সুপার-স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল তৈরির কাজ শেষ করতে হবে। কিন্তু সেই দফতরই স্বীকার করছে, তারা এটা জানে না যে, এই সময়সীমায় ‘অসাধ্য’ সাধন হবে কী করে। একাধিক স্বাস্থ্য-কর্তা এখন মানছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিশ্রুতি আর অপর্যাপ্ত পরিকাঠামোর শাঁখের করাতের মাঝখানে পড়েছেন তাঁরা।‘ব্যাকওয়ার্ড রিজিয়ান গ্রান্ট ফান্ড’-এ রাজ্যে মাল্টি স্পেশ্যালিটি ও সুপার স্পেশ্যালিটি মিলিয়ে মোট ৩৪টি হাসপাতাল তৈরির কথা। মাল্টি-স্পেশ্যালিটিগুলি ৫ তলা ও সুপার-স্পেশ্যালিটিগুলি দশ তলা হবে। প্রথম দফায় বাছাই করা হয়েছে ১৩টিকে (সুপার-স্পেশ্যালিটি)। এর মধ্যে মাল্টি-স্পেশ্যালিটিগুলির কাজ শেষের সময় মার্চ ২০১৪ (১৮ মাস) ও সুপার-স্পেশ্যালিটিগুলির ক্ষেত্রে ধার্য হয়েছে ২০১৫ সালের মে মাস (২৪ মাস)।
অথচ, সবগুলোরই পরিকাঠামোর দশা শোচনীয়। এই হাসপাতালগুলো গড়ার কথা ছিল মেডিক্যাল সার্ভিস কর্পোরেশন-এর। কিন্তু তাদের নিজের গঠনই সম্পূর্ণ হয়নি। টেকনিক্যাল কর্মী নিয়োগ করা হয়নি। তাই এক রকম বাধ্য হয়ে এ জন্য বেসরকারি সংস্থার দ্বারস্থ হতে হয়েছে। কিন্তু ২০১২ সালের একেবারে শেষে এসে ১৩টির মধ্যে সাতটির ক্ষেত্রে এখনও হাসপাতাল ভবন তৈরির জমি চিহ্নিত করে, প্ল্যান বানিয়ে, বাজেট তৈরি করে তার পরে দরপত্র ডাকবে এমন কোনও বেসরকারি সংস্থা-ই (সরকারি ভাষায়, ‘লিড কনসালটেন্ট’) খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, কোনও সংস্থা আগ্রহ দেখাচ্ছে না। আগ্রহ দেখালেও, এমন টাকা চাইছে যা স্বাস্থ্য দফতর দিতে অক্ষম। ফলে, প্রাথমিক স্তর থেকেই কাজ এগোনো যাচ্ছে না। এর থেকেও মারাত্মক সমস্যা তৈরি হয়েছে চিকিৎসক, বিশেষ করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ নিয়ে। এমনিতেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের অভাবে জেলার হাসপাতালগুলি ধুঁকছে। তার উপরে নতুন স্বাস্থ্য-জেলা তৈরি হওয়ায় সেখানেও বিশেষজ্ঞ লাগছে। এর পরে আবার অনুন্নত এলাকায় সুপার স্পেশ্যালিটি-র জন্য বিশেষজ্ঞ কোথা থেকে আসবেন, ভেবে পাচ্ছেন না স্বাস্থ্য-কর্তারা। |
স্বাস্থ্য অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথীর দাবি, “আমরা মোটামুটি হিসাব করেছি, ১৩টি হাসপাতালে ৩৯০ জন মেডিকা্যাল অফিসার, ন্যূনতম ১৫৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও অন্তত ২৬ জন স্নাতোকোত্তর স্তরের বা ডক্টরেট করা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক লাগবে।” কিন্তু একাধিক প্রাক্তন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা জানিয়েছেন, ভাল ভাবে পরিষেবা চালাতে হলে ১৩টি প্রস্তাবিত হাসপাতালে সব মিলিয়ে প্রায় ৮০০ চিকিৎসক লাগবে। বস্তুত বিশ্বরঞ্জনবাবুও মেনেছেন, “পরিকাঠামো তৈরি হয়ে গেলেও লোক না থাকলে তো হাসপাতাল চালানো যাবে না।”
চিকিৎসক আসবেন কোথা থেকে? রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা সুশান্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবাব, “ম্যাজিক হবে না। তবে ডাক্তার খোঁজা হচ্ছে। এক বছরের মধ্যে সব মেকআপ হয়ে যাবে। এমডি, এমএস-এ আমাদের আসন বেড়েছে। হুহু করে বিশেষজ্ঞ বেরোতে থাকবে।” কিন্তু এক বছর পরেও কোনও ‘ম্যাজিক’ আশা করছেন না স্বাস্থ্য-কর্তাদের একটা বড় অংশ। তাঁরা পাল্টা যুক্তি দিচ্ছেন, এমডি-এমএস পাশ করা চিকিৎসকদের প্রত্যেকেই যে সরকারি চাকরি করবেন, সেই নিশ্চয়তা কোথায়? অধিকাংশই বেশি বেতনে বেসরকারি হাসপাতালে যোগ দেবেন। যাঁরা সরকারি চাকরিতে আসবেন, তাঁদের আবার প্রাথমিক ভাবে বিভিন্ন জেলা হাসপাতালে নিয়োগ করতে হবে। তার পরে মাল্টি-স্পেশ্যালিটি বা সুপার-স্পেশ্যালিটি হাসপাতালের জন্য চিকিৎসক পাওয়া কতটা সম্ভব? স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী চন্দ্রিমা ভট্টাচার্য বলছেন, “হাসপাতালগুলো চালু হতে এখনও এক-দেড় বছর বাকি রয়েছে। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমরা তার মধ্যে পেয়ে যাব। এ নিয়ে মাথা ঘামাতে হবে না।”
তবে রাজ্যের স্বাস্থ্য-চিত্র সম্পর্কে সম্যক ধারণা রাখা প্রাক্তন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা জয়শ্রী মিত্রর মন্তব্য, “এক সঙ্গে এতগুলো মাল্টি-স্পেশ্যালিটি, সুপার-স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল ঘোষণা করে দেওয়াটা একটু অবাস্তব পরিকল্পনা হয়ে গিয়েছে। ১৩টা হাসপাতালে সব মিলিয়ে প্রায় ৭০০-৮০০ ডাক্তার লাগবে। বিশেষজ্ঞেরা মূলত গবেষণার কাজে, নিজস্ব প্র্যাকটিসে চলে যাবেন। জানি না, এই পরিকল্পনা কত দূর সময়মতো বাস্তবায়িত হবে।” আর এক প্রাক্তন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা চিত্তরঞ্জন মাইতির বক্তব্য, “হাসপাতালগুলো হবে মূলত জেলায়, অনুন্নত এলাকায়। বেশির ভাগ বিশেষজ্ঞ সেখানে যেতেই চাইবেন না। তাঁদের যে বেতন দেওয়া হবে, তাতেও তাঁদের অনেকের পোষাবে না। কারণ, বেসরকারি হাসপাতালে বেতন অনেক বেশি। ১৩টা দূর-অস্ত্, তিন-চারটে সুপার-স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল খোলা হলেই মনে করব, অনেক পেরেছে।” |