|
|
|
|
বহু কোটির কটেজ সাগরে, থাকবেন কে |
শুভাশিস ঘটক • গঙ্গাসাগর |
উৎকৃষ্ট শাল এবং সেগুন কাঠ, বেলজিয়ান কাচ, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র, আর লন্ডনসুলভ ত্রিফলা আলোয় (বিতর্কিত হলেও!) গঙ্গাসাগরে সাজছে কটেজ। থাকবেন কে? কোটি টাকার এই প্রশ্ন উড়ছে সাগরের হাওয়ায়। আর আমজনতার জল্পনায়, প্রশাসনের কানাঘুষোয়, নেতাদের ফিসফাসে উঠে আসছে একটাই নাম মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
প্রশাসনের কর্তাদের অনেকেরই মুখে কুলুপ। তবুও যা জানা যাচ্ছে, তা হল এ পর্যন্ত ২.৭২ কোটি টাকা অনুমোদন হয়ে গিয়েছে কটেজের জন্য। অনুমোদন হতে পারে আরও তিন কোটি। প্রায় তিন বিঘা জমির মাঝখানে এক হাজার বর্গফুটের একটি ঘর। লাগোয়া খাবার ঘর ও বাথরুম। শুধু বাথরুম সাজানোর খরচই ধরা হয়েছে প্রায় দেড় কোটি।
পূর্ত এবং জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর বানাচ্ছে ওই কটেজ। পিছনে হেলিপ্যাড, কটেজ ঘিরে প্রায় আড়াই বিঘে জমিতে গায়ে গায়ে শাল খুঁটি লাগিয়ে গড়া পাঁচিল, কয়েক পা দূরে ২০ ফুট উঁচু ‘ওয়াচ টাওয়ার’, কিছুটা দূরে প্রায় ৪০ ফুট উঁচু গোটা কুড়ি হ্যালোজেন লাইট সমৃদ্ধ বাতিস্তম্ভ।
জনস্বাস্থ্য কারিগরিমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “ও রকম একটা কটেজ হচ্ছে বটে। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী সেখানে থাকবেন কি না, কী করে বলব?” পুলিশ সুপার প্রবীণ ত্রিপাঠিও জানান, মুখ্যমন্ত্রীর সাগর-সফর নিয়ে শুক্রবার রাত পর্যন্ত প্রশাসনিক বার্তা নেই তাঁর কাছে। তবে জেলা প্রশাসনের এক কর্তা দাবি করেছেন, রাষ্ট্রপতি, রাজ্যপাল, রাজ্য সরকারের ‘বিশেষ অতিথি’মাপের মানুষদের জন্য ওই কটেজ হচ্ছে। |
সেই বিতর্কিত কটেজ।—নিজস্ব চিত্র |
পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে (প্রধানত দৈনন্দিন খরচ, বেতন, পেনশন দেওয়ার জন্য) এখন রাজ্য সরকারের হাতে টাকা নেই বলে বৃহস্পতিবারই কোচবিহারে জানিয়েছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের শূন্য ভাঁড়ারের জন্য দুষেছেন কেন্দ্রকে। সেখানে সাগরে এ ধরনের বিলাসবহুল
কটেজ বানানোর পিছনে যুক্তি কি, তা নিয়ে উঠছে প্রশ্ন। কারণ, সাগরে সরকারি থাকার জায়গা অনেক। যুব-আবাস, সার্কিট হাউস, জনস্বাস্থ্য কারিগরি, পূর্ত, সেচ, বন দফতরের অতিথি নিবাস, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের অতিথি নিবাস এবং সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের অতিথি নিবাস। সুন্দরবন উন্নয়ন দফতরের অতিথি নিবাস এবং যুব আবাস বাদ দিলে, অন্য সব জায়গাতেই দু’টি করে বিশেষ সাজানো-গোছানো ঘর রয়েছে সরকারি কর্তাদের জন্য। নির্মীয়মাণ কটেজটিকে যদি ভবিষ্যতে পর্যটনের স্বার্থে ব্যবহার না করা যায় (নিরাপত্তার প্রশ্নে) তা হলে সরকারি টাকা কেন ‘দরিয়ায় ঢালা’ হচ্ছে, সে প্রশ্নও উঠেছে।
সিপিএমের দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলা সম্পাদক সুজন চক্রবর্তীর কথায়, “নতুন কটেজটাকে যে ভাবে সাজানো হচ্ছে, যে ভাবে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হচ্ছে, মনে করা যেতেই পারে, সেখানে বিশেষ কেউ থাকবেন। মুখ্যমন্ত্রী যেখানে বারবার বাম-আমলে রাজ্যের ভাঁড়ার শূন্য হয়ে গিয়েছে
বলে কটাক্ষ করেন, সেখানে তাঁর আমলে সাগরে তৈরি হওয়া বহু কোটির এই কটেজে কে থাকবেন, জানতে ইচ্ছে হয় বইকী?”
সাত কোণা কটেজটা বানানোর জন্য গত কুড়ি দিন ধরে দিন-রাত এক করছেন পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাটের এক ঠিকাদার। কাজ করছেন ২৫ জন কর্মী। শালকাঠের কাঠামোর উপরে, বসছে সেগুনের তক্তা। ঘরের ভিতরে ও বাইরে পুরোটাই মুড়ে দেওয়া হচ্ছে সেগুনে। মধ্য কলকাতার ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি এলাকার একটি আসবাবপত্রের দোকান থেকে সেগুন কাঠ আসছে সাগরে। বসছে তিনটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র। ঘরের দু’দিকের দেওয়ালে বেলজিয়ান কাচের প্যানেল। ‘ওয়াচ টাওয়ার’-এও ওই কাচ বসবে বলে জানালেন, ঠিকাদার সংস্থার ম্যানেজার।
কাজ কত দূর?
ম্যানেজার বললেন, “অনেক বাকি। ঘরের ভিতরে সেগুন কাঠের কারুকাজ হবে। নানা ধরনের আলো বসবে। বাথরুমটাও একটু অন্য ধরনের করতে হবে।” কথার ফাঁকে কর্মীদের একপ্রস্ত তাড়া দিয়ে তাঁর সংযোজন, “৬ জানুয়ারি মুখ্যমন্ত্রী এই কটেজ উদ্বোধন করবেন বলে আমাদের জানানো হয়েছে। তাই দুশ্চিন্তা আরও বেড়েছে।” ঘটনা হল, ৬ জানুয়ারি সাগর মেলারও উদ্বোধন।
কটেজের সামনে থেকে সাগরতট পর্যন্ত প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ টাইলস বসানো রাস্তা হয়েছে। শুক্রবার সেখানে দাঁড়িয়ে আধা-সামরিক বাহিনীর এক জওয়ান মোবাইল ফোনে নির্দেশ দিচ্ছিলেন, “যাঁহা মমতাদি কা হাট বন রাহা হ্যায়, হাম ওঁয়াহা খাড়া হু। তুম চলে আও (যেখানে মমতাদির ঘর তৈরি হচ্ছে, আমি সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছি। তুমি চলে এস)।” কে বলল এ ঘরটা মুখ্যমন্ত্রীর জন্য? জওয়ানের বিস্ময়, “ইঁহা তো হর কোই অ্যায়সাহি জানতা হ্যায় (এখানে তো সবাই তেমনই জানে)!” |
|
|
|
|
|