১৯৯১ সালে টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার হইয়াছিলেন রতন টাটা। দুইটি কারণে এই ঘটনার বিশেষত্ব ছিল। ওই ১৯৯১ সালেই ভারতীয় অর্থনীতি তাহার পুরানো খাঁচাটি ছাড়িয়া বিশ্ব অর্থনীতির আকাশে উড়িবার চেষ্টা শুরু করিয়াছিল। পরবর্তী দুই দশক দেখিল, বিশ্বায়নের দুনিয়ায় ভারতীয় আর্থিক নীতির সংস্কারের সুযোগ কাজে লাগাইয়া পুরানো এবং অনেকাংশে স্থিতিজড়তায় আক্রান্ত টাটা গোষ্ঠীকে এক নূতন প্রাণশক্তিতে সমৃদ্ধ করিতে রতন টাটা চমকপ্রদ ভাবে সফল। পঁচাত্তর বছর বয়সে গতকাল যখন তিনি টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যানের পদ হইতে অবসর লইলেন, তখন গোষ্ঠীর মোট ব্যবসার আয়তন ১৯৯১ সালের তুলনায় (ডলার-মূল্যে) আঠারো গুণ; একটি ভারতীয় বৃহৎ গোষ্ঠী হইতে তাহা ইতিমধ্যে একটি আন্তর্জাতিক শিল্পগোষ্ঠীতে পরিণত, ব্রিটেনের বেসরকারি শিল্পে যে গোষ্ঠী সর্বাধিক কর্মীর কর্মসংস্থান করিয়াছে পরশুরাম কল্পিত ‘উলটপুরাণ’কে যাঁহারা সত্য করিয়াছেন, রতন টাটা তাঁহাদের অগ্রপুরুষ। ইস্পাত, রাসায়নিক পণ্য বা হোটেলের মতো পুরানো ক্ষেত্রগুলির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তি, টেলিকমিউনিকেশনস, ব্যক্তিগত মোটরগাড়ির নূতন ভুবনেও টাটা নামটি এই দুই দশকের মধ্যে আপন সিলমোহর আদায় করিয়া লইয়াছে। ১৯৯১ হইতে ভারতীয় অর্থনীতির উত্থান এবং টাটা গোষ্ঠীর অভিযান পরস্পরের সমান্তরাল। রতন টাটা বলিতেই পারেন: আজ আমি সুখী, এবং জয়ী।
এই সাফল্যের দুইটি বিশেষ অর্থ রহিয়াছে, যাহা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সীমা অতিক্রম করিয়া অর্থনীতির সামগ্রিক প্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ। এক, সরকারি নিয়ন্ত্রণের দ্বারা সংরক্ষিত যে অর্থনীতিতে রতন টাটা পূর্বাশ্রম কাটাইয়াছিলেন, নূতন অর্থনীতিতে তাহার অপ্রাসঙ্গিকতা বুঝিতে তাঁহার দেরি হয় নাই, বিশ্বায়নের বাস্তব হইতে মুখ না ফিরাইয়া তাহাকে বলিষ্ঠ সাহসে ব্যবসার উন্নতির জন্য ব্যবহার করার সুযোগ তিনি দ্রুত কাজে লাগাইয়াছিলেন। তাঁহার সাফল্য, আরও নানা পুরানো ও নূতন সংস্থার সাফল্যের মতোই, মুক্ত অর্থনীতির অমিত সম্ভাবনাকে প্রমাণ করিয়াছে। দ্বিতীয়ত, ব্যক্তিগত আচরণে এবং ব্যবসায়িক নীতি ও পদ্ধতিতে নিজস্ব মূল্যবোধে নিষ্ঠাবান থাকিয়াও যে নূতন অর্থনীতিতে সফল হওয়া যায়, তাহাও এই সাফল্যের এক বড় শিক্ষা। ‘১৫ কোটি টাকা উৎকোচ দিয়া নিজের বিমান পরিবহন সংস্থা চালু করিতে চাহি নাই’ বলিবার মধ্যে যে স্পষ্টবাক প্রত্যয় আছে, তাহা কেবল ব্যক্তির পক্ষে মূল্যবান নয়, অর্থনীতির পক্ষেও মূল্যবান। এই স্পষ্টভাষণেরই আর এক পরিচয় পাইয়াছিল হতভাগ্য পশ্চিমবঙ্গ, যখন তিনি সিঙ্গুর হইতে নিরুপায় বিদায়ের সিদ্ধান্তটি ঘোষণা করিয়াছিলেন। তাঁহার ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কাহিনিগুলি সুপরিচিত, তাঁহার সম্পর্কে প্রশ্নগুলিও অজানা নয়। কিন্তু ইতিহাস তাঁহাকে মনে রাখিবে এমন এক উদ্যোগী হিসাবে, আপন ভূমিতে স্থিত থাকিয়া যিনি উন্নয়নের দিগন্তকে ক্রমশ প্রসারিত করিয়াছেন। ইহার পরেও টাটা গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডে এবং অর্থনীতির বৃহত্তর পরিসরে তাঁহার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকিবে। সুতরাং, তাঁহাকে তাঁহার স্বদেশবাসী, শুভবিদায় নহে, অভিবাদন জানাইবে। |