ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্ক্সবাদী) নেতা এবং রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী আনিসুর রহমান উত্তর দিনাজপুরে জনসভায় অকল্পনীয় পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক মাপকাঠিতেও অকল্পনীয় কুৎসিত ভাষণ দানের দীর্ঘ এক দিন পরে ‘দুঃখিত’, ‘অনুতপ্ত’ এবং ‘ক্ষমাপ্রার্থী’ হইয়া যে বিবৃতিটি পাঠ করিয়াছেন, তাহার একটি অংশ প্রণিধানযোগ্য। তাঁহার বক্তব্য, ধর্ষণের ক্ষতিপূরণ প্রসঙ্গে তাঁহার মুখ দিয়া এমন কিছু উক্তি ভুলবশত নির্গত হইয়াছে, যাহা সৌজন্যবিরোধী। দুঃখিত, অনুতপ্ত এবং ক্ষমাপ্রার্থী হইবার জন্য মহামান্য বিধায়ককে কেন দীর্ঘ এক দিন অপেক্ষা করিতে হইল, তাহার উত্তর খুঁজিবার জন্য আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে দৌড়াইবার প্রয়োজন নাই। সাধারণ বুদ্ধি বলিয়া দেয়, দলের তাড়নাতেই তিনি এই বিবৃতি পাঠ করিয়াছেন। দলই বা কেন এমন ভয়ঙ্কর উক্তির পরেও আপন সদস্য ও নেতার জন্য কিঞ্চিৎ কঠোরতর শাস্তির বিধান না দিয়া একটি নিতান্ত ‘ছি, ও রকম করে না’ গোছের মৃদু ভর্ৎসনায় সীমিত থাকিল, তাহার কারণও নিতান্ত স্পষ্ট। স্থানীয় শক্তিতে শক্তিমান নেতা অত্যন্ত গর্হিত কাজ করিলেও তাঁহাকে শাস্তি দানের সাহস আলিমুদ্দিনের অধীশ্বরদের নাই, ধৃতরাষ্ট্রকে দুর্যোধনের অপকীর্তির সামনে অন্ধ হইয়া থাকিতে হয়। এক দুর্যোধন নয়, অনেক দুর্যোধন। অ-সভ্য এবং অ-শ্লীল উক্তির প্রতি সি পি আই এমের এই উৎকট এবং অন্যায় প্রশ্রয় অতীতেও রাজ্যবাসী বিস্তর দেখিয়াছেন।
কিন্তু গভীরতর প্রশ্ন হইল, দল কি সত্য সত্যই মহামান্য বিধায়কের উক্তিকে তিরস্কারযোগ্য মনে করে? না কি, দলের মতে, তিনি যাহা বলিয়াছেন তাহাতে অন্যায় কিছু নাই, থাকিলেও তাহা নিতান্তই তুচ্ছ ব্যাপার? প্রশ্নটি মনোভাবের। দলের মনোভাব এবং ব্যক্তির মনোভাব, একটি অপরটি হইতে বিচ্ছিন্ন নয়। আনিসুর রহমান বলিয়াছেন, তাঁহার মুখ দিয়া কিছু মন্তব্য ভুলবশত নির্গত হইয়াছে। দলও তাঁহাকে এমন ‘উক্তি’র জন্য সমালোচনা করিয়াছে। তাঁহার বিরুদ্ধে চতুর্দিক হইতে যে নিন্দাবাদ ভাসিয়া আসিয়াছে, তাহারও মুখ্য প্রতিপাদ্য: এমন কথা বলিতে নাই। বলিতে নাই, ভাবিতে আছে? ‘ভুল করিয়া’ই হোক বা প্রতিপক্ষের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং ঘৃণা প্রকাশের বেপরোয়া আকাঙ্ক্ষাতেই হোক, যে কথাগুলি উচ্চারিত হইয়াছে, সেগুলি আকাশ হইতে পড়ে নাই, বক্তার মন হইতেই উঠিয়া আসিয়াছে। মূল প্রশ্ন একটিই: যে মন এমন ভাবে ভাবিতে পারে, তাহাকে মন না বলিয়া আবর্জনার স্তূপ বলাই বিধেয় নয় কি? কেহ কুবাক্য কেন বলিয়াছেন, ইহা গৌণ প্রশ্ন। কু-ভাব কেন মনের মধ্যে বহন করিয়া বেড়াইতেছেন, তাহাই প্রকৃত বিচার্য।
সি পি আই এম রাজ্য সম্পাদক তাঁহার দলের স্বভাবসিদ্ধ আত্মশ্লাঘায় বলিয়াছেন, আনিসুর রহমানের উক্তি তাঁহাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিপন্থী। জানিতে বড় সাধ হয়, সেই সংস্কৃতিটি বিমানবাবুরা কোন সুদূর দ্বাপরে ঠিক কোন শমীবৃক্ষে লুকাইয়া রাখিয়াছেন। রাজ্যের জন্মলগ্ন, বা তাহার পূর্ব হইতেই কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজন উত্তর ‘প্রাকৃত’ সি পি আই এম নহে, অবিভক্ত ‘সংস্কৃত’ পার্টি অশালীন ব্যক্তিগত আক্রমণের সাধনা করিয়া আসিয়াছে সুভাষচন্দ্র বসু সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির সচিত্র বাণীমালা স্মরণীয়, কিংবা অতুল্য ঘোষ সম্বন্ধে তাঁহাদের উচ্চাঙ্গের রসিকতা। লক্ষণীয়, সুভাষচন্দ্র প্রসঙ্গে তবু কল্পান্তর পার করিয়া শেষ অবধি একপ্রকার ভুল সংশোধন করিয়াছেন, অতুল্য ঘোষ প্রশ্নে সেটুকুও করেন নাই। আনিসুর রহমান তো সেই পার্টিরই যোগ্য কমরেড। তাঁহাদের পরম সাফল্য এইখানে যে, ক্রমশ অন্য রাজনৈতিক দলগুলিও তাঁহাদের জঞ্জাল-মন্ত্রে দীক্ষিত হইয়াছেন বিনয় কোঙার, সুশান্ত ঘোষের প্রতিবিম্ব হিসাবে শুভেন্দু অধিকারী, কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায়রা নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করিয়াছেন। সাংসদ অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ও যে এই পুণ্যলগ্নে কুবাক্যের বিপণিতে আপনার এবং আপন দলের খাতা খুলিয়া ফেলিলেন, তাহা তাৎপর্যপূর্ণ। রাজ্য রাজনীতিতে কদর্যতার যে ধারাটি আদিগঙ্গার সমান্তরাল পঙ্কস্রোতে বহমান, তাহা এক গভীর অ-সভ্যতার পরিচায়ক। হয়তো অসভ্যতার শিকড় সমাজের গভীরে বিস্তৃত। মনোভাবের অসভ্যতা। ভাষা ভাবের বাহনমাত্র। |