সিপিএমের আনিসুর রহমান এবং কংগ্রেসের অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়ের অশালীন মন্তব্য নিয়ে ঝড় এখনও থামেনি। সেই কুবাক্যের স্রোতে এ দিন নিজের জায়গা করে নিলেন তৃণমূলের কাকলি ঘোষদস্তিদার। কুরুচিকর মন্তব্যের প্রতিযোগিতায় অন্তত শাসক ও বিরোধীর ব্যবধান ঘুচে গেল।
ফের শিরোনামে পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ।
মুখ্যমন্ত্রীর ‘সাজানো ঘটনা’র তত্ত্ব পার্ক স্ট্রিট মামলাকে যত না লঘু করেছিল, শুক্রবার অতীতের সব রেকর্ড ছাপিয়ে কাকলি পার্ক স্ট্রিটের নির্যাতিতাকে কার্যত প্রকাশ্যে যৌনকর্মী বলে উল্লেখ করলেন। বললেন, “ওটা ধর্ষণের ঘটনাই নয়। ওই মহিলা আর তাঁর খদ্দেরদের মধ্যে গোলমাল।”
কাকলির কথা শুনে নির্যাতিতার প্রতিক্রিয়া, “পরিস্থিতি যা দাঁড়াচ্ছে, হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে!” তার পরেই নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে তাঁর পাল্টা প্রশ্ন, “যৌনকর্মীকেও কি ধর্ষণ করা যায়? কাকলিদেবীর কথা শুনে মনে হচ্ছে, যৌনকর্মী ধর্ষিতা হলে যেন তাঁর বিচার চাওয়ার অধিকার নেই!” কাকলির এ দিনের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে, বাম আমলে বিরাটি গণধর্ষণ কাণ্ডের স্মৃতি। সেখানেও ধর্ষিতাদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন সিপিএম নেত্রী শ্যামলী গুপ্ত।
মুখ্যমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে সিপিএমেরই বিধায়ক আনিসুরের অশালীন মন্তব্যের প্রতিবাদে এ দিন অবশ্য মহাকরণে সাংবাদিক সম্মেলন করেছেন রাজ্যের দুই মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায় ও ফিরহাদ হাকিম। সেখানে তাঁরা জোর গলায় বলেছেন, নারীর সম্মান রক্ষাই এই সরকারের প্রধান কাজ। তত ক্ষণে টিভির পর্দায় দেখা যাচ্ছে, কাকলি বেশ সপ্রতিভ ভঙ্গিতে বলছেন, ‘‘পার্ক স্ট্রিটে আদৌ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেনি। পার্ক স্ট্রিটে যা হয়েছে, তা হল পেশাদার কাজকারবার নিয়ে ওই মহিলা এবং তাঁর খদ্দেরদের মধ্যে গোলমাল।’’ এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে মন্ত্রীরা বললেন, “আমরা কিছু বলব না। ওঁকেই জিজ্ঞাসা করুন।”
আনিসুর এবং অভিজিৎ নিজেদের মন্তব্য প্রত্যাহার করেছেন, ক্ষমা চেয়েছেন। বিতর্কের মুখে পড়ে কাকলি শুধু দাবি করছেন, ইংরেজি চ্যানেলটি তাঁর বক্তব্য বিকৃত করে প্রচার করেছে। তিনি বলেন, “আমার কিছু কথা কেটে বাদ দিয়ে অন্য কথা জুড়ে এ সব বলা হচ্ছে। ওই চ্যানেলটির বিরুদ্ধে আমি মামলা দায়ের করছি। মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশে আনিসুর রহমানের করা কটু মন্তব্যকে ঘিরে যে ঝড় উঠেছে, তা ধামাচাপা দিতেই আমার মন্তব্যকে বিকৃত করে এ সব করা হচ্ছে।” |
পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার পরেই মুখ্যমন্ত্রী একে ‘সাজানো ঘটনা’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। ক’দিন আগে মমতা-ঘনিষ্ঠ নাট্যকর্মী অর্পিতা ঘোষ কার্যত সেই তত্ত্বকে সমর্থন করে বলেন, ‘‘দিল্লির ধর্ষণ কাণ্ড আর পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার প্রেক্ষিত আলাদা। দুটি ঘটনার তুলনা চলে না।’’ নির্যাতিতা তার পরেই বলেছিলেন, “আমাকে মৃত্যুর সঙ্গে লড়তে হয়নি বলেই কি এ সব কথা বলা হচ্ছে?” এ দিন কাকলির বক্তব্যেও দিল্লি আর পার্ক স্ট্রিটকে আলাদা করে দেখানোরই চেষ্টা ছিল। চ্যানেল তাঁর বক্তব্য বিকৃত করেছে বলে দাবি করার পরে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হয়, তিনি ঠিক কী বলেছেন। তখনও কাকলি বলেন, “ওরা দিল্লির সঙ্গে পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার তুলনা করছিল। সে প্রসঙ্গেই আমি বলি, দিল্লির ঘটনা অনেক মর্মান্তিক। পার্ক স্ট্রিটের সঙ্গে তার তুলনা হয় না।” তা হলে কি তিনি স্বীকার করছেন যে, পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণ হয়েছিল? কাকলির উত্তর, “ওটা বিচারাধীন বিষয়। আমি কোনও মন্তব্য করব না। পুলিশ তদন্ত করছে।” কিন্তু পুলিশ তো ধর্ষণ হয়েছে বলেই জানিয়েছে। সাংসদের জবাব, “পুলিশি তদন্তে যা বেরিয়েছে, তা-ই। মন্তব্য করব না।”
কাকলির এ দিনের বক্তব্য প্রসঙ্গে জাতীয় মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন মমতা শর্মা বলেন, “এক জন মহিলা জনপ্রতিনিধির এমন কথা বলাটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এক জন মহিলা স্বেচ্ছায় নিজেকে ধর্ষিতা বলে পরিচয় দেন না। যৌনকর্মীকেও কেউ তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্পর্শ করতে পারে না।” একই সুরে রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া, “মহিলা নেত্রী হয়ে উনি যে মন্তব্যটা করেছেন, সেটা মানসিক বিকৃতির পরিচয়। ধর্ষণের রকমভেদ করা হচ্ছে, এর থেকে লজ্জার আর কিছু হতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রীর মুখ বাঁচাতে তৃণমূল নেতারা যুক্তিহীন কথা বলছেন।” প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি প্রদীপ ভট্টাচার্য বলেন, “পার্ক স্ট্রিটের ঘটনার যে চার্জশিট এখনও দেওয়া হয়নি, চাপ সৃষ্টি করে সেটাকে দুর্বল করতেই এই ধরনের উক্তি করা হচ্ছে। দিল্লির ঘটনার সঙ্গে এই ঘটনার কোনও তফাত নেই। দুটোই ধর্ষণ।”
পার্ক স্ট্রিটের তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই কলকাতা পুলিশের তৎকালীন গোয়েন্দাপ্রধান দময়ন্তী সেনকে সরে যেতে হয়। চার্জশিট পেশের ছ’মাস পরেও চার্জ গঠন করা যায়নি। ধরা পড়েনি মূল অভিযুক্ত। সরকার পক্ষের বিশেষ আইনজীবী জানিয়েছেন, তিন ধৃতের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট সময়েই চার্জশিট পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু তাঁর বক্তব্য, “অভিযুক্ত পক্ষ আদালতে নানা বিষয়ে পিটিশন দাখিল করছে। তার নিষ্পত্তি করতে গিয়েই চার্জ গঠন পিছোচ্ছে।” |