প্রায় সকলেই মনে করেছিলেন, এই বিদায় হবে রাজকীয়। উপচে পড়া সম্ভ্রম আর শ্রদ্ধায় টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হিসেবে শেষ বারের মতো ‘অফিসে’ আসবেন তিনি। ঝলসে উঠবে ফ্ল্যাশ বাল্ব। প্রতিক্রিয়া চেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়বে সংবাদমাধ্যম। আর এ সবের মাঝে সব আলো কেড়ে নিয়ে ‘রাজ্যপাট ছেড়ে’ চলে যাবেন রতন নভল টাটা।
কিন্তু বিদায়ী দিনে সম্ভবত সব থেকে বড় ধাঁধা হয়ে থাকলেন রতন টাটা নিজেই। নির্ঘণ্ট মেনে সেই ২৮ ডিসেম্বরই সিংহাসন ছেড়ে দিলেন। সরে গেলেন টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধারের পদ থেকে। হাত বদলাল ব্যাটন। সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকার চলে গেল সাইরাস মিস্ত্রির হাতে। কিন্তু সারা দিন টিভির পর্দায় উদ্গ্রীব চোখ রেখেও তাঁর দেখা মিলল না। সারা দিনে এক বারও বম্বে হাউসের (মুম্বইয়ে টাটা গোষ্ঠীর সদর দফতর) ত্রিসীমানাতেও দেখা গেল না তাঁকে। জানা গেল, পুণেতে সংস্থার গাড়ি কারখানার কর্মীদের সঙ্গেই পঁচাত্তরতম জন্মদিন কাটিয়েছেন তিনি। নিজের মতো করে।
সব দেখে-শুনে অবশ্য দিনের শেষে অনেকটাই মত বদলে ফেলেছে শিল্পমহল। অনেকেরই মনে হচ্ছে, এমনই তো হওয়ার কথা ছিল। কারণ, নিজের জন্য ঠিক এ ধরনের চিত্রনাট্যই তো বরাবর লিখে এসেছেন রতন টাটা। আবেগহীন, অনাড়ম্বর। অথচ আভিজাত্যে টইটম্বুর। এ দিনও অবসরের মুহূর্তে উত্তরসূরির জন্য যাবতীয় পাদপ্রদীপের আলো তুলে রাখার বিরল সৌজন্য দেখিয়ে গেলেন তিনি।
অনেকেই আবার মনে করছেন, সরকারি ভাবে অবসর ঘোষণা হল ঠিক কথা। কিন্তু রতন টাটা তো সেই রতন টাটা-ই থেকে গেলেন। তা সে ‘পদাধিকার বলে’ই হোক আর ব্যক্তিগত ক্যারিশমার জৌলুসে। ইতিমধ্যেই নিজেদের শীর্ষ সাম্মানিক পদে (চেয়ারম্যান-এমেরিটাস) তাঁর নাম ঘোষণা করেছে টাটা গোষ্ঠী। শুধু তা-ই নয়, পুরোদস্তুর সক্রিয় ভাবে দেখভাল করবেন টাটা ট্রাস্টস্-এর। টাটা গোষ্ঠীর ধারক সংস্থা (হোল্ডিং কোম্পানি) টাটা সন্সের ৬৬ শতাংশ মালিকানা রয়েছে যাদের হাতে। সঙ্গে রয়েছে তাঁর ব্যক্তিত্ব আর অভিজ্ঞতার অক্ষয় তূণ। ঝড়-ঝঞ্ঝা সামলাতে যা হয়তো প্রায়ই প্রয়োজন হবে টাটাদের। তাই যতই তিনি অবসর কাটাতে আরব সাগরের তীরে বাড়ি করুন, ইচ্ছে দেখান পিয়ানো শেখার, সত্যিকারের ছুটি তাঁর কতটা হল, তা নিয়ে সময়ে সময়ে ধন্ধে পড়ে যাচ্ছে শিল্পমহল। |
|
ইউনিয়নের অনুরোধে আজ অবসরের আগে শেষ দিনটা পুণেতে টাটা মোটরসের
কারখানায় কর্মীদের সঙ্গেই কাটালাম। এর স্মৃতি চিরদিন অমলিন থাকবে।
রতন টাটা |
|
অবসরের দিনে কর্মীদের ই-মেল পাঠিয়েছেন রতন টাটা। অকুণ্ঠ ধন্যবাদ দিয়েছেন এই দীর্ঘ (চেয়ারম্যান হিসেবে ২১ বছর) সময় পাশে থাকার জন্য। কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন তাঁর উপর আস্থা রাখার কারণে। একই সঙ্গে, প্রত্যেকের কাছ থেকে একই রকম সমর্থন সাইরাসের জন্যও চেয়ে নিয়েছেন তিনি। সাফল্যের আগাম শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, গোষ্ঠী, সাইরাস এবং কর্মীদের। শোনা যাচ্ছে আগামী ৫ জানুয়ারি এক ঘরোয়া অনুষ্ঠানে তাঁকে বিদায় সংবর্ধনা দেবে টাটা গোষ্ঠী।
রতন টাটাকে কেন এ দেশের শিল্পমহল চিরকাল ‘লিজেন্ড’ হিসেবে কুর্নিশ করবে, রতন টাটার ওই ই-মেল থেকেই তা স্পষ্ট। তাঁর নিজের বয়ানে, গত ২০ বছরে টাটা গোষ্ঠীর ব্যবসা বেড়েছে প্রায় ২০ গুণ। ৮৫ টি দেশে ছড়িয়ে থাকা ৯৬ টি সংস্থার মোট আয় ছাড়িয়েছে ১০ হাজার কোটি ডলার। কিন্তু নারায়ণমূর্তির মতো অনেকেই মনে করেন, এই সব চোখ কপালে তুলে দেওয়া সংখ্যা নয়। রতন টাটার আসল কৃতিত্ব হল প্রথম ভারতীয় বহুজাতিক হিসেবে টাটা গোষ্ঠীকে গড়ে তোলা।
টাটা ব্র্যান্ডকে বিশ্বের দরবারে সযত্নে তুলে ধরেছেন তিনি। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দিয়েছেন তার পরিচিতি। সব থেকে বড় কথা, কোনও ভারতীয় সংস্থার পক্ষে যে এমনটা আদৌ করা সম্ভব, তা দেখানোর ক্ষেত্রে তিনিই পথিকৃৎ। পুরোপুরি কাকতালীয়, কিন্তু যে বছর (১৯৯১) চেয়ারম্যান হিসেবে টাটা গোষ্ঠীর দায়িত্ব নিচ্ছেন রতন টাটা, সে বছরই চমকে দেওয়া বাজেটে ভারতের সামনে উদার অর্থনীতির রাস্তা খুলে দিচ্ছেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। এর পর গত দু’দশকে ভারতের অর্থনীতির কক্ষপথ যেমন আমূল বদলে গিয়েছে, তেমনই রতন টাটার হাত ধরে বিশ্বের দরবারে অন্যতম পরিচিত ব্র্যান্ড হয়ে উঠেছে টাটা গোষ্ঠী।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য শিল্প নিয়ে পড়ার পাঠ শেষ করে ১৯৬২-তে টাটা গোষ্ঠীতে যোগ দেন রতন টাটা। ১৯৯১ সালে উঠে আসেন সর্বোচ্চ পদে। দায়িত্ব নেন টাটা গোষ্ঠীর চেয়ারম্যান হিসাবে। তার পর প্রায় দু’দশকের এই দীর্ঘ যাত্রায় শতাব্দী প্রাচীন টাটা গোষ্ঠীকে বিশ্বের দরবারে শক্তিশালী ব্র্যান্ড হিসাবে প্রতিষ্ঠা করাকেই বরাবর পাখির চোখ করেছেন তিনি। আমজনতার সাধপূরণের লক্ষ্যে এক লক্ষ টাকার ন্যানো বাজারে আনাই হয়তো তাঁর সব থেকে বেশি চর্চিত পদক্ষেপ। বার বার আলোচনায় এসেছে টাটা মোটরসের যাত্রিবাহী গাড়ি বিভাগকে তৈরি করার ক্ষেত্রে তাঁর প্রবাদপ্রতিম সাফল্যও। কিন্তু যে ভাবে তিনি বিদেশের মাটিতে একের পর এক সংস্থা কেনার ‘স্পর্ধা’ দেখিয়েছেন, তা আসলে বিশ্বের দরবারে সাবালক করেছে ভারতের শিল্পকে। |
যে মূল্যবোধ ও নীতি মেনে এই উচ্চতায়
পৌঁছেছেন, তা অনুকরণযোগ্য।
এন আর নারায়ণমূর্তি |
বিশ্বের দরবারে টাটা গোষ্ঠীকে তুলে
ধরার কারিগর। অবসর জীবনের শুভেচ্ছা।
আদি গোদরেজ |
শুধু ব্যবসায়িক সাফল্য পেতে আদর্শ থেকে
সরে আসেননি। অসাধারণ কৃতিত্ব।
রাহুল বজাজ |
|
২০০০ সালে ব্রিটিশ চা সংস্থা টেট্লি দিয়ে শুরু। এর পর ২০০৪ সালে দেয়ু-র বাণিজ্যিক গাড়ি। ২০০৫-এ সিঙ্গাপুরের ন্যাটস্টিলের পর ২০০৭ সালে চোখ কপালে তুলে দিয়ে ১,২০০ কোটি ডলারে ইস্পাত বহুজাতিক কোরাস। ২০০৮-এ ফের ২৩০ কোটি ডলারে ব্রিটিশ গাড়ি বহুজাতিক জাগুয়ার-ল্যান্ড রোভার। এ ভাবে একের পর এক নামী সংস্থাকে পকেটে পোরার দৌলতেই আজ সংস্থার ৫৮ শতাংশ ব্যবসা আসছে বিদেশের মাটি থেকে। এর বাইরেও তাঁর সাফল্যের মুকুটে পালক হিসেবে থেকেছে টিসিএস-কে দেশের বৃহত্তম তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা হিসেবে প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব। টাইটান ও তনিষ্কের অভাবিত সাফল্য। এবং অবশ্যই বিদেশে (বিশেষত ইউরোপ ও মার্কিন মুলুকে) ইন্ডিয়ান হোটেলসের ব্যবসা সম্প্রসারণ।
কিছুটা পিছন থেকে দৌড় শুরু করেই টাটা গোষ্ঠীর শীর্ষ পদে উঠে এসেছিলেন তিনি। চলার পথে যে কখনও কোনও সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠেনি, এমনও নয়। যেমন অনেকেই বলেন, প্রায় জলের দরে টাটাদের প্রসাধনী ব্যবসা বেচে মস্ত ভুল করেছিলেন তিনি। গোড়ায় বুঝতে পারেননি টাইটানের বিপুল সম্ভাবনা। নিখাদ পণ্য হিসেবে বাজারে তেমন কল্কে পায়নি ন্যানোও। কিন্তু এ সবের পরও দিনের শেষে দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কর্ণধার হিসেবে সম্ভ্রম আদায় করে নেবেন তিনি। প্রশংসা পাবেন পরবর্তী প্রজন্মের নেতৃত্ব তৈরি করার জন্য। কারণ, তাঁর ছত্রচ্ছায়াতেই তো টাটা স্টিল, টাটা মোটরস কিংবা টিসিএসের কর্তা হিসেবে বি এস মুথুরামন, রবি কান্ত আর রামোদরাইয়ের অমন চোখ ধাঁধানো দৌড়।
ব্যবসার বৃত্তের মতো ব্যক্তিগত ভাবনা-চিন্তার পরিসরেও রতন টাটা একই রকম। সৎ, নিয়মনিষ্ঠ এবং সোজাসাপ্টা। যে কারণে ঘুষ দিয়ে বিমান পরিবহণ ব্যবসায় নামার প্রস্তাবে মন্ত্রীর মুখের উপর না বলে দিতে পারেন তিনি। কিংবা আলাপচারিতায় অক্লেশে বলতে পারেন নিজের জীবনে চার-চার বার প্রেম আসার কথা। রতন টাটা এ রকমই। এফ-সিক্সটিনে চড়ার সময় যেমন, ব্যক্তিগত জীবনেও তা-ই। লক্ষ্যে স্থির, ঋজু। বরাবরের ‘স্টেটসম্যান’। অযথা প্রচার থেকে একশো হাত দূরে। যার নমুনা অবসরের দিনেও রেখে গেলেন তিনি। |