এত দিন তাঁরা তুমুল তর্ক জুড়েছিলেন, চল্লিশ পর্যন্ত খেলা অনুচিত, অন্যায়। চিঠিটা পেয়েই তাঁদের আবার সব মনে এসে গেছে। তেন্ডুলকর ক্রিকেট-ঈশ্বর। কারণ টেকনিকসমৃদ্ধ, রেকর্ডে ছয়লাপ অলৌকিক এক কেরিয়ার। আমরা এত দিন এই অকৃতজ্ঞদের স্পর্ধায় হায়রে বলে মাথা চাপড়াচ্ছিলাম, এখন তিতিবিরক্ত। হিসেব-খাতা নয়, আমরা তো জীবন দিয়ে জানি, তেন্ডুলকর কে! ভগবান। আমাদের ভগবান। আমরা, যারা নব্বইয়ের দশকে অক্ষর চিনছি, মানুষ পদবাচ্য হচ্ছি, জানছি ক্রিকেট নামের একটা খেলা হয়। আর, ঠিক তখন থেকেই তাঁকে চিনেছি। তাঁকে, না তাকে? ওই একরত্তি মানুষটাকে কি আপনি বলা যায়?
বড় হচ্ছিলাম আর ওই মানুষটাও উল্কার বেগে তেন্ডুলকর হয়ে উঠছিল। অদ্ভুত আরাম লাগত। এ গ্রহের দ্য ‘বেস্টেস্ট’ ক্রিকেটার এই দেশেরই! ওর জন্যই অন্য দেশ ফ্যালফ্যাল দেখে ইন্ডিয়াকে। আমাদের স্বপ্নরা উসকে উঠত। কোনও বিষয়ে সেরা হওয়াটা, এমনকী জিনিয়াস বনে যাওয়াটাও অলীক বস্তু নহে। কিন্তু, এ কী সিস্টেম! শুনছি সারা টিম বিশ্রাম নিচ্ছে, আর স্বয়ং ক্রিকেটঠাকুরের বরপুত্রটিই কিনা একলা নেটে এসে প্র্যাকটিস প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্র্যাকটিস। ডেডিকেশন, ডিটারমিনেশন! অতএব, আমিও সারা রাত পড়ব, খাটব, আর লক্ষ্যে পৌঁছবই।
চৌত্রিশ হাজার রানের সবটা আমাদের ঠোঁটস্থ। ত্রিশ নাগাদ একটা চান্স থাকে, তার পর হাফসেঞ্চুরি তক স্মুদ, ষাট-সত্তর ডেঞ্জারাস, আশির ঘর হালকা মেঘলা, তার পর সেই বিখ্যাত বুক দুরদুর, টেন্ডুলকর অন নাইনটিজ। ক্রিজে এসে স্ট্রেট ড্রাইভে বুলেট চার, স্কোয়্যার কাটে সাঁইসাঁই দু’রান। তক্ষুনি ফর্মটা চিনে ফেলতাম। আজ ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ঠিক।
কোনও দিন আবার ব্যাটে মোটে দশ, কিন্তু বলে হঠাৎ পাঁচ উইকেট, হাত-পা ভেঙে বাউন্ডারি বাঁচাবেন। অন্যের স্ট্রাইক, তবু নিজের ঝুঁকিতে এককে দুই, দুইকে তিন করবেন। অমনি ঝকঝক করবে তাঁর ক্রিকেট কফিনের অশোকচক্র। ও নিজের রেকর্ডের জন্য খেলে এ সব কথা তখন দে দৌড়। তিনি তখন কচিকাঁচা ফ্যানগুলোকে মাঠ থেকে বলছেন, অ্যাই, আমার মতো হবে? তবে, নিজের কাজটাকে এমনি করে ভালবাসো তো দেখি! ম্যাচের আগে নাকি চুপ করে একলা বসে থাকতেন, বা কানে ইয়ারপ্লাগ গুঁজে গান শুনতেন। কোনও কাজে নামার আগে মনকে তৈরি করার এই শিক্ষাটাও তোমারই দেওয়া, সচিন!
যে বোলার দাঁত খিঁচোল, পিচে রাস্তা আটকাল, কোনও এক পরের ম্যাচে তার হয়ে গেল। খেলছে সচিন মারছে সচিন, টগবগবগ ফুটছে সচিন। অন্যায়কে এই ভাবে, নিখুঁত ভদ্রতায় জীবনের অনেক বাইরে ফেলে দিতে হয়। অগুনতি অ্যাড করেছেন, তামাক অ্যালকোহলের একটাও না। বিশ্বকাপ এলেই তাঁর দিকে আকুল তাকিয়েছি, খুব খারাপ হারে কত জন শালীনতা ডিঙিয়েছে। তবু তিনি মাইক ধরে গোটা জাতিকে জিতের প্রমিস করেছেন আর করেও দেখিয়েছেন। আমরা ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের শৌর্যে মুগ্ধ, আর আইডলের দায়িত্ববোধেও।
অতিমানব নন। রোজ ম্যাচ জেতাননি। কিন্তু পাঁচ ফুট পাঁচ, একটা অনেক উঁচু চূড়ায় উঠে আমাদের ডেকেছেন। এইখানে এসো। ছুটেছে বিরাট কোহলি, যুবরাজ, রায়না। আমরা সব্বাই, সব দিক থেকে ছুটেছি। তাই তাঁকে গড ডাকি আমরা, ‘আমরা’ ভারতের আন্ডার থার্টি জেনারেশন। যারা সবাই এখন টিভি আর মন নিভিয়ে বসে। স্কুল কলেজ পেরিয়ে, এই অ্যাডাল্ট-জীবনেও সেটা যে অত্যাশ্চর্য ভাবে সঙ্গেই ছিল। হিরো কাপের রাত, সাউথ আফ্রিকাকে বোকা বানানো শেষ ওভার, শারজার মরুঝড় হয়ে, ওয়ান ডে’র ডাবল সেঞ্চুরির সেলিব্রেশনে, ভুবনজয়ের স্বপ্নমুহূর্তের পরেও, গত তেইশ বছর ধরে, সেটা তাঁর সঙ্গে জগ করতে করতে, বাইশ গজে স্টান্স নিত। আর নেবে না। নীল রঙের দশ নম্বর জার্সির সঙ্গেই সে-ও অস্ত গেল। বিস্ময়বালক আমাদের অলৌকিক শৈশবটাও তাঁর সঙ্গে নিয়ে গেলেন।
যৌবন-বার্ধক্য নিয়ে আঁক কষতে ব্যস্ত যাঁরা, সেই পরমবিজ্ঞমণ্ডলী এই নিগূঢ় রহস্যের কী বা বুঝবেন? |