প্রায় তিন মাস পরে আবার উত্তরবঙ্গের পথে আসছেন মুখ্যমন্ত্রী। পথ কিন্তু রয়েছে একই জায়গায়।
তরাই-ডুয়ার্সের জাতীয় সড়কের ভয়ঙ্কর দশা যেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অস্বস্তি’র কারণ না হয়ে ওঠে, তার জন্য অবশ্য তৎপর হয়েছে রাজ্য পুলিশ-প্রশাসন। পূর্ত দফতরের সঙ্গে কেন্দ্রের আওতাধীন জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের বার্তা চালাচালি হয়েছে অনেক। তার নির্যাস, বাদানুবাদ ভুলে আপাতত বালি, পাথর, পিচ ঢেলে মুখ্যমন্ত্রীর যাত্রাপথ কিছুটা মসৃণ করা হোক। সে কাজও হচ্ছে।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী তো গত সফরে বলেছিলেন, লগ্নি নিয়ে আসবেন। |
তা আসবে কি? যেখানে আজও রেলের বৈদ্যুতিকীকরণ হয়নি, যেখানে এখনও রাতে বিমান ওঠানামা করে না, সেখানে রাস্তা ভাল না-হলে যে বিনিয়োগ টানা কিংবা সার্বিক উন্নয়ন কষ্টসাধ্য, তা নিয়ে শাসক দলের নেতা-কর্তাদেরও সন্দেহ নেই। শিল্পমহলও পরিকাঠামোর উন্নতির বিষয়ে বারবার জোর দিচ্ছে। “উত্তরবঙ্গ গোটা রাজ্যের মধ্যে শিল্প-বাণিজ্যে সব চাইতে অবহেলিত,” বলেন ফেডারেশন অব চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, নর্থ বেঙ্গল-এর সম্পাদক বিশ্বজিৎ দাস। “রেল-সড়ক ও বিমান যোগাযোগ মান্ধাতা আমলের। আশা করব, মুখ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে বঞ্চনা ঘুচবে।”
মুখ্যমন্ত্রীর পথ চেয়ে রয়েছে আরও অনেকে। ডুয়ার্সের চা বলয়ের আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ দীর্ঘ দিন ধরেই ‘বিচ্ছিন্ন ও অবহেলিত’ হওয়ার ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। তাঁদের বেদনাকে হাতিয়ার করতে নানা শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠেছে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতম দেবও। আর এক সমস্যা জমিজট। বিহারে চার লেনের মহাসড়কের কাজ মসৃণ ভাবে হলেও বাম আমল থেকেই জমি জটের জেরে উত্তরবঙ্গে তা থমকে রয়েছে। উত্তরবঙ্গের ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্তাদের অনেকেরই ধারনা, তৃণমূল অধিগ্রহণের বিরোধী, তাই অনিশ্চিত হচ্ছে মহাসড়কের কাজ। |
উত্তরবঙ্গে আজ আসছেন মুখ্যমন্ত্রী। (বাঁ দিকে) কোচবিহার সার্কিট হাউসে প্রস্তুতি। নাগরাকাটায়
সরেজমিনে প্রস্তুতি দেখছেন উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব। ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব ও দীপঙ্কর ঘটক। |
ঘটনা হল, গত জুলাই ও অগস্টে, দু’দফায় মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে এসেছেন। প্রতিবারই বেহাল জাতীয় সড়ক দেখে ক্ষোভে ফেটে পড়েছেন তিনি। তাঁর নির্দেশে খোদ উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের অফিস ঘেরাও করে আন্দোলন করেছেন। কাজের কাজ হয়নি। উপরন্তু, খানিকটা সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামের ধাঁচে ‘ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি’ তৈরি করে ডুয়ার্সের কয়েকটি এলাকার চাষিরা আন্দোলনে নেমেছেন। ফুলবাড়ি, ধূপগুড়ি, ফালাকাটা শহরে রাস্তা চওড়া করাতে হলে স্কুল, হাসপাতাল সরানোর দরকার। সেখানেও আপত্তি উঠেছে। জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট জানিয়েছে, রাস্তা চওড়া করার জন্য প্রয়োজনীয় জমির ৮০ শতাংশ হাতে না-পেলে কাজ শুরু হবে না।
বিমান যোগাযোগেও হতাশাই প্রাপ্তি। কোচবিহারে উড়ান চালু হওয়ার মাসখানেকের মধ্যে বন্ধ হয়ে গিয়েছে। বাগডোগরায় রাতের উড়ান আজও চালু হয়নি। পাহাড়-তরাই-ডুয়ার্সে হেলিকপ্টার পরিষেবার প্রকল্পের কাজ এগোয়নি। তবে ‘সুইৎজারল্যান্ড’ গড়ার স্বপ্ন সফল করতে বিনিয়োগকারীরা আসবেন কেন, সেই প্রশ্ন তুলেছে চা-পর্যটন মহল।
উত্তরবঙ্গ উন্নয়ন মন্ত্রী গৌতমবাবু অবশ্য আশা দেখাচ্ছেন। তিনি বলেন, “আমরা হাল ছাড়ব না। ইতিমধ্যেই ইসলামপুর এলাকায় জমি জট ছাড়ানো হয়েছে। ডুয়ার্সের জমি জটিলতার নিষ্পত্তি করতে জলপাইগুড়ির জেলাশাসককে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে। আমরাও বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলছি। কারও একচুল ক্ষতি না-করে আলোচনার ভিত্তিতে জমি নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ করা হবে। নিন্দুকরা যাই-ই বলুক না কেন, মুখ্যমন্ত্রী উত্তরবঙ্গে উন্নয়নের যে কর্মযজ্ঞের সূচনা করেছেন তার গতি উত্তরোত্তর বাড়বে।” |
খোলেনি যে সব বন্ধ বাগান |
• ঢেকলাপাড়া চা বাগান
মার্চ ২০০৬ থেকে বন্ধ।
শ্রমিক সংখ্যা ৬০৪ জন।
নানা রোগে
বাগানে ১২৫ জনের মৃত্যু। |
• দলমোড় চা বাগান
অগস্ট,
২০১২ থেকে বন্ধ।
শ্রমিক সংখ্যা ৫৫০।
নানা রোগে ১৭
জনের মৃত্যু। |
মাথাব্যথার রাস্তা |
ঘোষপুকুর-আলিপুরদুয়ার চার লেনের সড়কের জমি অধিগ্রহণ নিয়ে জট।
• দৈর্ঘ্য ১৫৫ কিলোমিটার।
• প্রকল্প ব্যয় ২২১২ কোটি টাকা।
• চওড়া করতে বাড়তি জমি দরকার ৬২৫ হেক্টর।
• ২০০৯ সালে জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু।
• ২০ শতাংশ অধিগ্রহণ হয়েছে।
• ৮০ শতাংশ অধিগ্রহণ না হলে কাজ শুরু করে না জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। |
কোথায় জট |
• ফুলবাড়ি, ফাটাপুকুর, অসম মোড়, ময়নাগুড়ি, ধূপগুড়ি, ফালাকাটা, সোনাপুর
(প্রায় ১২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য)
বর্তমান রাস্তার দু’ধারের দোকানদারেরা ক্ষতিপূরণ
ও সুষ্ঠু পুনর্বাসন (বিকল্প জমি) ছাড়া সরবেন না।
• জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য
• ক্ষতিপূরণ বাবদ টাকা দেওয়া হয়। বিকল্প জমি কোথায় পাব? |
ফল |
• শিলিগুড়ি-জলপাইগুড়ি জাতীয় সড়ক প্রায় তিন বছর ধরে পুরোপুরি বিধ্বস্ত।
আপাতত সারাতে সাড়ে ৭ কোটি টাকা দরকার। বরাদ্দ মেলেনি। |
পাহাড়ে |
• শিলিগুড়ি-দার্জিলিং জাতীয় সড়ক
• ধস, ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হয়ে দু’বছর ধরে এই রাস্তা বন্ধ। সংস্কার
করতে ৮৪ কোটি টাকা দরকার। বরাদ্দ পায়নি জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ। |
|