ফুটবলের মাঠেই মুক্তির খোঁজে বন্দিদের টিম |
জোরালো শট বা নিখুঁত ট্যাকলে একদা পাড়ার হিরো ছিল তারা। স্বপ্ন দেখত, কলকাতার ঘেরা-মাঠে খেলার!
কৈশোরে কুসঙ্গে পড়ে সেই স্বপ্ন চুরমার। ফুটবল-মাঠের বদলে তাদের ঠিকানা এখন সংশোধনাগার। সেই অন্ধকার থেকেই ফের ঘুরে দাঁড়ানোর শুরু।
সৌজন্যে রাজ্যের বন্দি-দলের খেলোয়াড় দল। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলে ছড়িয়ে থাকা বন্দিদের মধ্যে ফুটবল-প্রতিভাদের খুঁজে বার করতে উদ্যোগী জেল কর্তৃপক্ষ। তালিম দিয়ে দল গড়ে তাঁদের কলকাতা ময়দানের লিগে নামানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে।
তাই কয়েক বছরের ব্যবধানে ভেঙে যাওয়া স্বপ্নটা নতুন করে আঁকড়ে ধরেছেন সোমনাথ মিস্ত্রি বা অ্যালবার্ট পেরিয়াল। আন্তঃসংশোধনাগার প্রতিযোগিতায় ইতিমধ্যে রীতিমতো চোখে পড়েছেন তাঁরা। জগন্নাথ, জামশেদ, শেরু, সাহেবরাও এই কৃতীদের দলে। বয়স বেশির ভাগই বিশের কোঠায়। একটা সময়ে খুন, অপরাধ, লুঠের মতো ঘটনায় তাঁরা জড়িয়ে পড়েছিলেন। অপরাধীর অতীত ভুলে এখন ফুটবলার পরিচয়েই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাইছেন তাঁরা।
এই যুবকদের ঘিরে চারপাশের লোকজনদের ধারণাটাও পাল্টাতে শুরু করেছে। উত্তর কলকাতায় বস্তির ঝুপড়ি ঘরে সোমনাথের মা পদ্মাদেবী বলছেন, “সে দিন দমদমের জেলে ওর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে শুনি, সবাই আমায় বলছে, আপনি তো ফুটবলার সোমনাথের মা! শুনে কী যে ভাল লাগল!” ১৮ বছর বয়সে এক ডাক্তারকে অপহরণের ঘটনায় জেলে যায় সোমনাথ। বাবা কিছু দিন ধরেই যক্ষায় ভুগছিলেন। ছেলের জেলে যাওয়ার খবর পেয়ে আর বাঁচেননি। অথৈ জলে পড়ে গোটা পরিবার। এখন মেয়ে (সোমনাথের বোন)-কে নিয়ে বাড়ি-বাড়ি কাজ করে সংসার চালান পদ্মাদেবী। অপরাধী ছেলের জন্য অনেক দিন বাদে গর্বিত মা। |
দক্ষিণ কলকাতার অ্যালবার্ট বাড়ির সব থেকে ছোট ছেলে। পড়ায় তেমন মন বসত না। বরাবরই ফুটবল ধ্যানজ্ঞান। ২০০৫ সালে কয়েক জন বন্ধুর সঙ্গে অ্যালবার্ট জড়িয়ে গিয়েছিলেন ভবানীপুরের এক ডাকাতির মামলায়। ১৮ বছর বয়সে জেলে যায়। তার মা বাসন্তীদেবী বলছিলেন, “এক সময়ে ওর জন্য অনেক কেঁদেছি। এখনও কষ্ট হয়। কিন্তু এটা ভাল লাগছে যে, সবাই ওর খেলার প্রশংসা করছে।”
কী ভাবে খেলার মাঠে ফিরলেন এই বন্দিরা?
আইজি (কারা) রণবীর কুমার বলছিলেন, কালচারাল থেরাপি বা সাংস্কৃতিক নিরাময়ের অঙ্গ হিসেবেই বন্দিদের ফুটবল খেলা চালু হয়েছিল। ওদের খেলা দেখেই প্রতিযোগিতা চালু করার কথা ভাবা হয়! কারা দফতরের ডিআইজি (প্রশাসন) হরিহরপ্রসাদ মণ্ডলের কথায়, “এখন মনে হচ্ছে, জব্বর টিম। ময়দানের লিগেও ভাল খেলবে।” লিগে দল নামানোর আর্জি জানিয়ে আইএফএ-র কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন আইজি।
আইএফএ সচিব উৎপল গঙ্গোপাধ্যায় বলছেন, “খুবই ভাল উদ্যোগ। চিঠি পেলেই আমি সব রকম সাহায্যের চেষ্টা করব।” দমদম এবং আলিপুর সংশোধনাগারের দুই ফুটবল কোচ মিহির দাস এবং অরিন্দম মুখোপাধ্যায় জানান, আলিপুর, প্রেসিডেন্সি, দমদম, মেদিনীপুর, জলপাইগুড়ি, বহরমপুর ছ’টি কেন্দ্রীয় সংশোধনাগারের ৪০ জন খেলোয়াড়কে নিয়ে শীঘ্রই শিবির শুরু হবে। সেখান থেকেই ২৫ জনের চূড়ান্ত দল গঠন।
এর আগে কবাডিতেও রাজ্যস্তরে সফল হয়েছে বন্দিদের দল। সংশোধনাগারের একটি ক্লাব গড়ে সব খেলার দলকেই তার অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। কারা দফতরের ডিআইজি (প্রশাসন) হরিহরপ্রসাদ মণ্ডল জানালেন, নতুন ক্লাবের নাম হচ্ছে ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল কারেকশনাল হোম স্পোর্টিং ক্লাব’। |