দরিদ্রনারায়ণ সেবায় পাত পেড়ে খাওয়ানো হয়। কিন্তু এমন কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ, করে কে?
বস্ত্র বিতরণের লাইনে হুড়োহুড়ি করে শাড়িটা-কম্বলটা জুটেছে। কিন্তু খাওয়ার পরে হাতে নতুন শাড়ি তুলে দিয়ে কেউ গাড়ি করে পৌঁছে দেয়নি নির্দিষ্ট ফুটপাথের ‘দোরগোড়া’য়।
বড়দিনে এমনই এক অনুষ্ঠান শেষে তাই এক বৃদ্ধা ভিক্ষাজীবীর চোখে জল। বললেন, “এখানে এলে কিছু ক্ষণের জন্য সব দুঃখ-কষ্ট ভুলে যাই। আমাদের তো কেউ এমন আদর-যত্ন করে খেতে দেয় না!”
শ’দুয়েক বৃদ্ধা ভিক্ষাজীবীর জন্য এমন আদর-আপ্যায়নের ব্যবস্থা করেন তারক দাস। বাড়ি অশোকনগরের ১/৩ এলাকায়। একাই থাকেন মানুষটি। বড়দিন উপলক্ষে আলোয় ঝলমল করছে বাড়ি। সকাল থেকেই অতিথিদের ভিড়। সকলেই আশপাশের এলাকায় ভিক্ষা করেন। প্রায় কুড়ি বছর ধরে বড়দিনে এঁদের জন্য ঢালাও খাওয়াদাওয়ার আয়োজন হয় তারকবাবুর বাড়িতে। কার্ড ছাপানো হয়। লেখা থাকে, “শুভ বড়দিনে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আপনি অতিথি হিসাবে আসবেন।” |
এমন অনুষ্ঠানের কথা মাথায় এল কী করে? পেশায় ডাকবিভাগের কর্মী তারকবাবু জানালেন প্রায় তেত্রিশ বছর আগের এক ঘটনার কথা। সে দিন কলকাতায় একটি বিয়েবাড়িতে গিয়েছিলেন তারক। দেখেছিলেন, বিয়েবাড়ির সামনে বৃদ্ধা ভিক্ষাজীবীদের হুড়োহুড়ি। দু’মুঠো খেতে চান সকলে। কিন্তু অনুষ্ঠানবাড়িতে ঢুকতেই দেওয়া হল না কাউকে।
ঘটনাটা মানসিক ভাবে ক্ষতবিক্ষত করে যুবক তারককে। ঠিক করেন, সাধ্যমতো বছরে একটি দিন বৃদ্ধা ভিক্ষাজীবীদের ভালমন্দ খাওয়াবেন। সারা বছরের ‘অনাদর’ ভুলিয়ে দেবেন। বছর বাহান্নর তারকবাবুর সেই ইচ্ছে অপূর্ণ থাকেনি। যে কারণে ভোজ খেয়ে উঠে অশীতিপর এক বৃদ্ধাকে বলতে শোনা গেল, “অনেক অপমান সহ্য করে বেঁচে আছি। একটা দিন অন্তত সে সব ভুলে থাকতে পারি।” প্রতি বছর বড়দিনে ম্যারাপ বাঁধা হয়। টাঙানো হয় যিশুখ্রিস্টের ছবি। তা ছাড়া, বেঞ্চ পেতে ঢালাও খাওয়া-দাওয়ার আয়োজন তো আছেই। এ বারের মেনু ছিল ডাল, ভাত, আলুর চিপস্, মাছের মাথা দিয়ে লাল শাক, পাবদা মাছ, চাটনি। শেষ পাতে মিষ্টি। অশোকনগর ছাড়াও হাবরা, চাঁদপাড়া, গুমা, বিড়া প্রভৃতি এলাকায় বৃদ্ধা ভিক্ষাজীবীদের খুঁজে খুঁজে কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করে আসেন তারকবাবু।
কিন্তু বড়দিনটিকেই কেন বেছে নিলেন? প্রৌঢ়ের কথায়, “এ বড় আনন্দের দিন। এমন শুভ দিনে এই মানুষগুলোকে একটু আনন্দ দিতে চাই।” এলাকার দুঃস্থ কিছু পড়ুয়াকে বইপত্রও দেন তিনি। সন্ধ্যায় ছিল সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। নিমন্ত্রিতেরা কেউ রাতে থেকেও গেলেন। তাঁদের জন্য দস্তুরমতো ঢালাও বিছানা-লেপ-কম্বলের বন্দোবস্ত ছিল।
অশোকনগরের সফদলপুর এলাকা থেকে অনুষ্ঠানে এসেছিলেন বৃদ্ধা গঙ্গাদাসি দাস। যিশু কে জানেন? প্রশ্ন শুনে ফোকলা গালে হাসলেন গঙ্গাদাসি। বললেন, “অত জানি না বাপু। তারককে চিনি।” |