শেষ ডিসেম্বরের সন্ধ্যায় ধুলো আর কুয়াশার চাদরে মোড়া সেই মহল্লার পথে পথে ভেসে বেড়ায় এক আশ্চর্য সঙ্গীত। তার সুরে কখনও পল্লিগীতি, কখনও কীর্তন, কখনও ভাটিয়ালির ছোঁয়া। অথচ গানের বাণী একেবারেই অন্যরকম‘আসছেন প্রভু আসছেন / দূতেই দিল সংবাদ / আসছেন প্রভু আসছেন।’ নানা বয়সের এক দল নারী-পুরুষ। কারও হাতে গিটার, কারও গলায় হারমোনিয়াম, কারও সঙ্গে পরিষ্কার খোল-কর্তাল।
বড়দিনের আগে ন’দিন ধরে এই ভাবেই জনপদে গান গেয়ে শোনানো হয়, প্রভু আসছেন। প্রবীণ মিহির এ লুইস বলেন, “১৬ ডিসেম্বর থেকে এই গান গাওয়া শুরু হয়। সেখানে জাতি ধর্মের কোনও বাছ বিচার নেই।” বাংলার খ্রিস্টগান নিয়ে ক্ষেত্র সমীক্ষার কাজ করেছেন সুব্রত পাল। তিনি বলেন, “পদাবলী শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন সাহেবরা। তাঁরা রেভারেন্ড মতিলাল মল্লিক, যিনি মতিলাল পাদরি নামে বিখ্যাত, তাঁকে নবদ্বীপে পাঠিয়ে দিলেন কীর্তন শিখতে। মতিলাল বহু বছর ধরে নবদ্বীপে কীর্তনের চর্চা করেন। শেখেন পদাবলীও। তারপরে সেই সুরে বাইবেলের গল্প, যিশুর উপদেশাবলি, বাণী বসিয়ে এই নতুন ধারার গান বাঁধলেন।”
তারপরে মতিলালের কাছে শেখেন অনেক খ্রিস্টান যুবক। সুব্রতবাবু বলেন, “মতিলালের অন্যতম প্রধান শিষ্য ছিলেন বীরেন মণ্ডল। তিনি প্রয়াত। তার ছেলে স্যামুয়েল মণ্ডল চাপড়া এলাকায় খুবই জনপ্রিয় গায়ক ও গীতিকার ছিলেন। প্রায় পাঁচশোর বেশি গান লিখেছিলেন স্যামুয়েল। তাঁর গানে কীর্তন, বাউল, দরবেশ, লালনেরসব ধারার প্রভাব পড়েছে।”
নদিয়ার প্রায় সব গির্জাতেই বড়দিনের উৎসবে বাংলায় গান গাওয়া হয়। গির্জার গান বলতে যে পশ্চিমী সুরের কথা মনে পড়ে, অর্গানের সঙ্গত বা সমবেত গান, তার লেশমাত্রও পাওয়া যায় না কোনও কোনও এলাকায়। রানাঘাটের বেগোপাড়া চার্চে নিত্য প্রার্থনা করেন সেবিকা মিত্র। তাঁর কথায়, “অনেক আগে ল্যাটিন এবং তারপরে ইংরেজিতে গান হত বলে শুনেছি। তবে আমি বরাবর বাংলাতেই বড়দিনের উৎসবে গান গেয়েছি ও শুনেছি।” মিহির এ লুইস বলেন, “কোথাও একই গান গাওয়া হয়, কোথাও নতুন গান গাওয়া হয় প্রতি বছর।” লোকগায়ক অভিজিৎ বসুও এই গান নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি বলেন, “এদেশে ধর্মপ্রচারের জন্য এসে মিশনারিরা এমন একটি মাধ্যমই খুঁজছিলেন। তাঁরা দেখেন যে, এই গানের চলন চেনা, মানুষের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নাতীত তাই সেই সাহায্য তাঁরা নিয়েছিলেন।” তিনি বলেন, “শুধু কথা বদলানো হল, সুর একই রইল অনেক ক্ষেত্রেই। যেমন ‘ভোর হইল, ভানু প্রকাশিল / উঠ সবে যিশু গুণ গাও রে’ একটি খুবই প্রচলিত সঙ্গীতের সুরে বাঁধা। ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে গগনচন্দ্র দত্ত গানটি রচনা করেন।” |