সৌহার্দ্যের সিরিজ বলা হচ্ছিল। পাকিস্তান বোর্ড তাদের প্রাক্তন সব অধিনায়ককে সৌহার্দ্যের এক একজন রাষ্ট্রদূত হিসেবে এ বার ভারতে পাঠিয়েছে। অথচ সফরের প্রথম দিনই যে ধরনের জঙ্গি মনোভাব দেখা গেল, তুলনায় জাভেদ মিয়াঁদাদকেও সন্ন্যাসী মনে হবে।
দু’বল বাকি থাকতে পাঁচ উইকেটে জিতল পাকিস্তান। টিম ইন্ডিয়ার দুর্দশার ঘড়ায় আর একপ্রস্ত অন্ধকার ছিটিয়ে দিয়ে। টি-টোয়েন্টি যুদ্ধে এই প্রথম ভারত হারল পাকিস্তানের কাছে। কিন্তু সে সব ছাপিয়ে যেমন আক্রমণাত্মক মেজাজ ফুটে উঠল বাইশ গজে, অবিশ্বাস্য! আর একটু হলে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যেত।
প্রধান অপরাধী ইশান্ত শর্মা। নিজের দেশের মাঠে শুরু থেকেই মাথা গরম করছিলেন। ব্যাটসম্যানকে একবার ইচ্ছাকৃত অবস্ট্রাক্ট করলেন। তারপর কামরান আকমলের দিকে তেড়ে এলেন মারতে। বার্বেডোজের মাঠে স্টিভ ওয় বনাম কার্টলি অ্যামব্রোজের পর এ রকম মুখোমুখি সংঘাতের পরিস্থিতি আগে তৈরি হয়নি। রাতে ধোনি আনন্দবাজারের কাছে বললেন, “প্রধান দোষটা কামরানের। ও গালাগাল দিয়েছে। ইশান্ত কিন্তু শুধু তেড়ে গেছে। গালাগাল দেয়নি।” গোটা মাঠ এবং টেলিভিশনের কোটি কোটি দর্শক কিন্তু দেখেছে, ইশান্তও গালাগাল দিয়েছেন। কপিল দেব যেমন আনন্দবাজারকে বললেন, “ম্যাচ রেফারি রোশন মহানামার উচিত এখুনি দু’জনের ম্যাচ ফি থেকে মোটা টাকা কেটে নেওয়া। ওদের শুনানিতে ডাকারও দরকার নেই। পাঁচ বছর পর দ্বিপাক্ষিক সিরিজ চালু হয়েছে। এ কী চ্যাংড়ামি হচ্ছে?” |
ভারত-পাক সংঘাতের পারদ চড়াচ্ছেন ইশান্ত-কামরান। |
মহেন্দ্র সিংহ ধোনির অধিনায়কত্বের সোনার সময়ে এই সব ম্যাচ দশ বারে সাড়ে ন’বার জিতবেন বললে ভুল বলা হবে। দশ বারে দশ বারই জিতবেন। অথচ আজ শেষ ওভারে হেরে গেলেন। টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বকালীন বিপর্যয় দেখিয়ে ভারত ম্যাচটা বলতে গেলে বড়দিনের উপহার দিয়ে গেল প্রতিবেশী দেশকে।
টি-টোয়েন্টি ইতিহাসের সর্বকালীন বিপর্যয়ের ইতিহাস হল দক্ষিণ আফ্রিকার বিনা উইকেটে ৮৪ রান থেকে ১৩৩ অলআউট হয়ে যাওয়া। শেষ দশ উইকেট যাওয়া ৪৯ রানে। আর আজ ভারতের শেষ ন’উইকেট গেল ৫৬ রানে। অজিঙ্ক রাহানে আর গৌতম গম্ভীর যে ভাবে শুরু করেছিলেন, তাতে মনে হচ্ছিল টিম ইন্ডিয়ার যত খারাপ সময়ই যাক, পাকিস্তানের উপর টি-টোয়েন্টি আধিপত্যে ফাটল ধরবে না। ১১ ওভারে চালাতে গিয়ে রাহানে আউট। তার পর ধড়ধড় উইকেট পড়া শুরু হল। যে টিমে ঘরোয়া ক্রিকেটে দুটো ট্রিপল সেঞ্চুরি করা রবীন্দ্র জাডেজা আট নম্বরে ব্যাট করতে নামেন, তাদের এমন ভেঙে পড়ার একটাই ব্যাখ্যা হয়। মানসিক বিশৃঙ্খলা। ধোনি দল গঠনেও ভুল করেছেন। রবিচন্দ্রন অশ্বিনকে আচমকা তিনি বাদ দিয়ে দিলেন। রোহিত শর্মার বদলে আজ অশ্বিন থাকলে খেলা শেষে পাকিস্তানিরা দৌড়তে দৌড়তে এসে স্টাম্প তুলে নিয়ে যেত না!
মুসৌরিতে বন্ধুর কটেজে বসে এই ম্যাচটা অবশ্যই সচিন তেন্ডুলকর দেখেছেন। এটাও নিশ্চয়ই লক্ষ করেছেন, পরের পর ভুল সিদ্ধান্তে ভারতীয় দল কী ভাবে গাড্ডা থেকে গভীরতর গাড্ডার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। রবি শাস্ত্রীকে দেখলাম প্রচণ্ড চটে আছেন নির্বাচক প্রধান সন্দীপ পাটিলের ওপর। শাস্ত্রী বলছিলেন, “পাটিল কী এমন দিগ্গজ হয়ে গেল যে সচিনকে এ ভাবে অবসর নিতে বাধ্য করবে? আজ প্রথম দিনেই পাকিস্তান বোলিংয়ের যা হাল দেখলাম, ওয়ান ডে-তে উল্টো দিকে ব্যাটটা নিয়ে কে দাঁড়াবে?” |
চিন্নাস্বামী স্টেডিয়ামে ম্যাচ শুরুর আগে। |
সচিন এমনিতেও ভারতের হয়ে টি-টোয়েন্টি খেলেন না। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতির মাধ্যমে আজ যে ফের হারের অধ্যায় শুরু হল, তা সুদূরপ্রভাবশালী হবে কি না তাই এখন প্রশ্ন। অনেকের মনে হচ্ছে পাকিস্তান বোধহয় বহু দিনের ভারত-জুজু আজ কাটিয়ে ফেলল।
সচিন একটা সময় ভারতীয় ক্রিকেটে সান্তা ক্লজের উপহারের মতো এসেছিলেন। দু’হাজার বারোর বড়দিনে আরও এক উপহার পেল ভারতীয় ক্রিকেট। ভুবনেশ্বর কুমারকে।
সচিন তেন্ডুলকরের সঙ্গে গ্রহনক্ষত্রে, লতাপাতায় কোথাও যেন একটা জড়িত থাকার ভাগ্য আছে ভুবনেশ্বর কুমারের। এমনিতে বাইশ বছরের সিমার সম্পর্কে জাতীয় ক্রিকেটরসিকের অজ্ঞানতা নিয়ে বিস্ময়ের কিছু নেই। ক্রিকেট প্রেসবক্সই বা কতটুকু জানত। এটুকু বুঝত, নাম যাই হোক, এ ভুবনেশ্বরে থাকে না। আর আইপিএল খেলে। উত্তরপ্রদেশের সাংবাদিকদের বাইরে অনেকেরই খেয়াল ছিল না, বাইশ বছরের সিমার সম্পর্কে আরও একটা লাইন বলার আছে। ভুবনেশ্বর কুমার একমাত্র বোলার যিনি ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে তেন্ডুলকরকে শূন্য রানে আউট করেছেন। সে দিন খেলা শেষে ভুবনেশ্বরের ফোনে নাকি টানা দু’ঘণ্টা লাইন পাওয়া যায়নি। আসলে সচিন হলেন ভুবনেশ্বরের আরাধ্য। আরাধ্যকে শূন্য রানে আউট করাটা তাঁর কাছে স্রেফ কল্পবিজ্ঞান।
এ দিনও জাডেজার চতুর্থ ডেলিভারিটা শোয়েব মালিক স্ট্রেট ছক্কা না মারলে ভুবনেশ্বরই ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। আর তাঁর ফোনেও হয়তো সারা রাত লাইন পাওয়া যেত না। পেস বোলারের স্বপ্নের অভিষেক ঘটালেন যে তিনি। ৪-০-৯-৩। পাকিস্তানের যখন ১১ রানে ৩ উইকেট পড়ে গিয়েছে, তখন কি ধোনি ভুবনেশ্বরের চতুর্থ ওভারটা রেখে দিতে পারতেন না? কপিল অবশ্য বলছিলেন, “আমি হলেও ওভারটা করিয়ে নিতাম। কারণ, তখন আরও একটা উইকেট পড়ে গেলে ম্যাচ পুরো চলে আসে।” |
মনোজ প্রভাকরের পর এত ভাল ডান-হাতি সুইং বোলার বোধহয় এ দেশে আসেনি। উমর আকমলকে যে বলটায় ভুবনেশ্বর বোল্ড করলেন, সেটা ভারতীয় পেস বোলারের স্বপ্নের পেন্টিং। তাঁর স্পেল শেষ হওয়া মাত্র শোয়েব মালিক (৫০ বলে ৫৭ ন.আ.) আর মহম্মদ হাফিজ (৪৪ বলে ৬১) খেলাটা ধরে নিলেন।
দুর্ধর্ষ মোগলাই রান্নায় পাকিস্তানিদের যেমন খ্যাতি, রান তাড়া করার ব্যাপারে ঠিক ততটাই বিশ্বব্যাপী অখ্যাতি। আজ তীব্র স্নায়ুযুদ্ধের ম্যাচে সেই অখ্যাতি তারা কাটিয়ে উঠল। প্রথম দশ ওভারে মাত্র ৪৫-৩ থেকে ম্যাচ নিয়ে চলে গেলেন হাফিজ-শোয়েবরা। তাঁদের হিসেব ছিল, শিশির পড়লেই ভারতীয় স্পিনাররা অকেজো হয়ে যাবে। যুবরাজ আর কোহলিকে আক্রমণ করে দশ থেকে পনেরো ওভারের মধ্যে তাঁরা খেলাটা ঘুরিয়ে দিলেন।
ভুবনেশ্বরের মতো এ রকম অনেক তরুণের স্বপ্নের দিন ভিত্তি করে অধিনায়ক ধোনি প্রচুর ম্যাচ জিতেছেন। তাঁর অধীনে রাতারাতি নতুন প্লেয়ার এসে নাম করেছে। তাঁকে ভিজিয়ে দিয়েছে ম্যাচ জয়ের প্রশংসায়। এই ধোনির বোধহয় আর ভাগ্য কাজ করছে না। ক্লোজ ম্যাচ মানেই হারছেন।
|
আত্মহারা আফ্রিদি। মঙ্গলবার। |
আর ভুবনেশ্বর? অন্য দিন হলে অবধারিত মুসৌরি থেকে তাঁর জন্য একটা ফোন বা এসএমএস আসত। এখন আর সেই রাম নেই। সেই অযোধ্যা নেই। সেই সচিন নেই। সেই টিম ইন্ডিয়াও নেই। ভুবনেশ্বরকে তাই আরাধ্যের সঙ্গে দেখা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ধোনির দর্পচূর্ণের দিনেও ভুবনেশ্বরের ইনবক্সে বোধহয় মেসেজটা এল না।
|
সংক্ষিপ্ত স্কোর: ভারত ১৩৩-৯ (গম্ভীর ৪৩, রাহানে ৪২, উমর গুল ৩-২১), পাকিস্তান ১৩৪-৫ (হাফিজ ৬১, শোয়েব মালিক ৫৭ ন. আ, ভুবনেশ্বর ৩-৯)। |