নতুন নয় এ দাবি। রাজনীতি আর শিক্ষার বিকট মেলবন্ধন
পুরনো দাবিকে এক ভয়ঙ্কর চেহারা দিয়েছে। লিখছেন
সীমান্ত গুহঠাকুরতা |
নতুন কোনও ব্যাপারই নয় এটা। প্রতিবার মাধ্যমিকের টেস্টের রেজাল্ট বেরুনোর পর একই দাবি তোলা হচ্ছে অনেক দিন ধরে: ফেল করা ছাত্রছাত্রীদের পাশ করিয়ে দিতে হবে। চাপের পরিণাম কী হবে, আগে সেটা নির্ভর করত প্রধানশিক্ষক সহ অন্যান্য শিক্ষকদের চারিত্রিক দৃঢ়তার ওপর। হুমকি-ধামকি যিনি অগ্রাহ্য করতে পারতেন, ছাত্রমহলে এবং স্থানীয় মানুষজনের কাছে ‘বাঘের বাচ্চা’ উপাধি জুটত তাঁর। এ সবই অবশ্য মাননীয় কাউন্সিলর বা পঞ্চায়েত প্রধানদের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশের আগেকার কথা। সামগ্রিক রাজ্য-রাজনীতির ধারা মেনেই এখন ছাত্রছাত্রী এবং তাদের অভিভাবকদের ‘ভোটার’ (এবং হবু-ভোটার) পরিচয়টাই মুখ্য হয়ে উঠেছে। ফলে তাদের অন্যায় দাবির পক্ষে গলা ফাটানোর লোকের অভাব নেই। ছাত্রছাত্রীরাও এই হিসেবটা দিব্য বুঝে গেছে যে, এ রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছাটাই আইন। এবং পেশিশক্তির জোরে অনায়াসে সেই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায়। অতএব ভাঙো টেবিল-চেয়ার-আলমারি, বাঁকিয়ে দাও ক্লাস-রুমের ফ্যানের ব্লেড, ঘেরাও করো মাস্টার-দিদিমণিগুলোকে। ভয়ে ওদের হাড় হিম হয়ে যাক। ‘আমাদের’ এলাকায় চাকরি করতে এসে ‘ওদের’ এত মাজার জোর আসে কোত্থেকে শুনি? |
মাস্টার-দিদিমণিদের মনে ওই ভয়টা আমূল বিঁধিয়ে দেওয়া গেছে বলেই ‘ফাইনাল’ নিয়েও আর কোনও চিন্তা নেই। ওখানে তো গণ-টোকাটুকি আছেই। ফাইনালে সিট পড়ে অন্য স্কুলে। সেখানে তো সবাই ‘বহিরাগত’। আগে অচেনা জায়গা নিয়ে ভয়ডর ছিল, সে সব দিন এখন চলে গেছে। এ রাজ্যের রাজনীতি আমাদের শিখিয়েছে যে, সর্বত্রই বহিরাগতদের যা-খুশি করার অধিকার থাকে। যে-সব ছেলেমেয়ে তাদের নিজের স্কুলের ছেলেবেলা থেকে চেনা মাস্টারমশাইদের রেয়াত করে না, তারা আজকের দুনিয়ায় অন্য স্কুলে পরীক্ষা দিতে গিয়ে কোন মূর্তি ধারণ করতে পারে, তা বোঝা খুব কঠিন নয়।
তাই, মাধ্যমিক বা উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় গার্ড দিতে আসা ‘ইনভিজিলেটর’-রা আজকাল কড়িকাঠের দিকে চোখ রেখে বসে থাকতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। কারণ, তাঁদের অক্ষত দেহে বাড়ি ফেরার তাগিদ আছে। সে তাগিদ খুব অন্যায্যও নয়। স্কুল-কর্তৃপক্ষও তাঁদের সেই মর্মেই ‘ইনস্ট্রাকশন’ দিয়ে রাখেন। কেননা, বিদ্যালয়ের স্থাবর সম্পত্তির ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার আশঙ্কাটি বড়ই উদ্বেগজনক। এবং সে ক্ষতি অপূরণীয়, আক্ষরিক অর্থেই।
অতএব পরীক্ষা কেন্দ্রের বাইরে দু’জন পুলিশকর্মী বেঞ্চের ওপর বসে বসে বাদামভাজা খান। বন্দুকদুটো হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা থাকে বেঞ্চের গায়ে। ও দিকে স্কুলের পিছনবাগে পাইপ বেয়ে, কার্নিশ বেয়ে উঠে ‘টুকলি’ সাপ্লাই দিতে থাকেন লোকাল দাদারা। বেঞ্চের নীচে, বাথরুমে, সিঁড়িতে সেই টুকলির স্তূপ জমে পাহাড় হতে থাকে। বাইরে থেকে চিৎকার করে দাগ-নম্বর ধরে ধরে উত্তর বলে দেওয়াও চলতে থাকে। স্কুল চত্বরগুলো জুড়ে তখন সে যেন এক মোচ্ছব। সেই ভৈরব-বাহিনীকে সামলানোর দায়িত্ব যার, সেই হেডমাস্টারমশাই তখন বহুবিধ প্রকট এবং
প্রচ্ছন্ন হুমকির চাপ মাথায় নিয়ে জবুথবু হয়ে বসে থাকেন নিজের চেয়ারে।
বছরে দু’বার এই প্রহসন দেখতে দেখতে ইদানীং মনে হয়, সত্যিই তো, কী দরকার এত ঝকমারির? ‘হোম সেন্টারেই’ পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হোক, আর সবাইকে হরেদরে পাশ করিয়ে দেওয়া হোক, যেমনটা হবে এ বছর থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। শিক্ষক নামধারী একদল ভীতু মধ্যবিত্ত মানুষকে ‘অন্যায় সহ্য করা’র এই কঠিন পরীক্ষা আর তুমুল বিবেকদংশনের মধ্যে ফেলে কার কী লাভ হচ্ছে? লক্ষ্য যেখানে শুধুমাত্র কিছু ‘শিক্ষিত নির্বোধ’ তৈরি করা? ‘শিক্ষাক্ষেত্রে রাজনীতির অনুপ্রবেশ’ জাতীয় বাক্যবন্ধগুলো এখন বহুব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেছে। অপরিসীম নৈরাজ্যের অবসানে দরকার একটা তুমুল সংস্কার। ‘শিক্ষা-প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ’ যে এ রাজ্যে বিশেষ কোনও সুফল দেখাতে পারেনি, সেই সত্য এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। বিদ্যালয়গুলোর গালে লেগে থাকা ‘পরিচালন সমিতি’ নামের সেই দুষ্ট-ব্রণগুলোকে এ বার গেলে দেওয়াই ভাল। তাতেই প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটা ‘রাজনৈতিক-ভারমুক্ত’ হবে। এখন যা অবস্থা, তার থেকে খারাপ আর কিছু হতে পারে না।
বিদ্যালয়গুলোকে তো আর দিনরাত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় মুড়ে রাখা যাবে না। সেটা বাঞ্ছনীয়ও নয়। অতএব অন্য ভাবেই ভাবতে হবে। আমাদের রাজ্যে শিক্ষকমহলে একটা চালু রসিকতা আছে। যদি প্রশ্ন করা হয়, ‘প্রাণী কয় প্রকার ও কী কী?’ উত্তর হবে, ‘দু’প্রকার: মেরুদণ্ডী প্রাণী আর হেডমাস্টার’। দ্বিতীয় শ্রেণিটা বামফ্রন্টের জমানার সৃষ্টি। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছেন, তাঁরা নমস্য। কিন্তু বাকিদের একটু শক্তপোক্ত প্রশাসক বানিয়ে তোলার জন্য কিছু রিফ্রেশার কোর্স-টোর্সের ব্যবস্থা করা যায় কি? |