পিতৃতন্ত্রের মুখে ছাই দিয়ে মেয়েরা নিজের পায়ে উঠে দাঁড়াচ্ছে। পুরুষের একাধিকারে ঘা
পড়ছে। তাই কি পুরুষের এত রাগ? নারীকে নিগ্রহ ও হত্যা করে রাগ প্রকাশ করছে সে?
বোলান গঙ্গোপাধ্যায় |
রাজধানী দিল্লির বাসে ধর্ষণের ভয়াবহ ঘটনাটি নিয়ে শোরগোল চলছেই। ‘কঠোরতম শাস্তি’র চেনা দাবিও উঠেছে। অস্বাভাবিক নয়। ভয়ানক অপরাধের উচিত শাস্তি নিশ্চয়ই জরুরি। এ দেশে বহু ক্ষেত্রেই অপরাধী ধরা পড়ে না, শাস্তি হয় না, তাই এই শোরগোল, এই দাবি খুব প্রয়োজনীয়ও বটে। কিন্তু এটাও কি জানা দরকার নয় যে, যারা এমন অপরাধ ঘটায়, তাদের মনের গতিপ্রকৃতি ঠিক কেমন? মনোবিদদের দিয়ে তাদের মানসিকতার যদি খানিক আন্দাজও পাওয়া যেত, আর সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যেত, তা হলে হয়তো অপরাধ দমন একটু সহজ হত, সমাজের চেহারাটাও অন্তত একটু বদলাত।
এই সূত্রেই একটা বড় প্রশ্ন মনে আসে। ধর্ষণ নামক হিংস্রতার যে নজিরগুলি আমাদের চোখের সামনে কেবলই উৎকট হয়ে ওঠে, সেগুলির মধ্যে একটি যোগসূত্র আছে কি? যে সূত্রের নাম, এক কথায়, বিপন্ন পৌরুষ? যে বিপন্নতা জন্ম নেয় দীর্ঘ একাধিপত্যে আঘাত পড়লে? সেই আধিপত্যের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ দেখা দিলে? নারীর জন্য পুরুষের ঠিক করে দেওয়া গণ্ডি ছাড়িয়ে যতই মেয়েরা নিজেকে ‘মানুষ’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করছে, পুরুষের আধিপত্য আর সেই আধিপত্যজনিত ‘নিরাপত্তা’র বোধ কি ততই বিঘ্নিত হচ্ছে? আর তাই, একচ্ছত্র অধিকারে ঘা পড়ছে বলেই কি তার এত রাগ? সুযোগ পেলেই নারীকে নিগ্রহ করে, হত্যা করে সেই রাগ প্রকাশ করছে সে? আসলে কি সে বলতে চায়: কেন তুমি গণ্ডির বাইরে পা রেখেছ? |
অন্দরমহল। ‘দহন’ ছবির সেই পরিচিত দৃশ্যটি। |
রাস্তাঘাটে, বাসে বা গাড়িতে, অচেনা শহরে যে মেয়েরা ধর্ষিত হয়, লক্ষ করলে দেখা যাবে, তাদের অনেকেই, হয়তো অধিকাংশই এই লক্ষ্মণরেখা পার হয়েছে। পুরুষের সঙ্গে অর্ধেক না হোক, কিছুটা আকাশ ভাগ করে নিতে চেয়েছে। দাবিদার হয়েছে বাইরের পৃথিবীর আলোহাওয়ার। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ডের মেয়েটি যেমন নিজের অধিকারে ‘নাইট ক্লাব’-এ গিয়েছিলেন। তখনই তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, এটা বাড়াবাড়ি। আর এই বাড়াবাড়ির শাস্তিও এ ভাবেই পেতে হবে। আশ্চর্য এই যে, পৌরুষের এই শাস্তিবিধানে সমাজেরও পরোক্ষ সায় থাকে। সমাজও মনে করে, সর্বত্র মেয়েরা নিজেদের অধিকার চাইবে এটা ঠিক না। কোথাও একটা সীমারেখা থাকা দরকার। ঠিক ধর্ষণে সায় হয়তো নয়, কিন্তু ধর্ষণ যে হতে পারে, এই চিন্তায় সায়।
শুধু কি ধর্ষণ? হিংসা কি অনেক সময়েই প্রচ্ছন্ন নয়? অনেক মেয়ের দৈনন্দিন জীবনেই তো এ প্রশ্ন বহুশ্রুত। ‘গণ্ডির বাইরে কেন পা রেখেছ’ এ তো বহু পুরুষ প্রতিনিয়ত বলতে বা বুঝিয়ে দিতে চায়। যে মেয়েটি নিষেধের বেড়া ভেঙে আত্মপ্রকাশ ঘটায় তাকে কেবল বাইরে নয়, শোবার ঘরেও পুরুষের এই মানসিকতার মুখোমুখি হতে হয়। এই হিংসাকে মেনে নিয়েই সংসার করতে হয়। সামাজিকতা বজায় রাখতে হয়। ধর্ষণকে দেখা যায়, নিন্দা করা যায়, আইন দিয়ে মোকাবিলার চেষ্টা করা যায়। কিন্তু প্রতিনিয়ত পৌরুষী হিংসার এই নির্মম প্রকাশের বিরুদ্ধে কোনও ধর্মযুদ্ধ হয় না। যার যার লড়াই, তাকেই লড়তে হয়। যে পারে, সে পারে, আর যে পারে না, সে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায়।
ব্যক্তি-পুরুষ যখন হিংস্র, তখন সে ভয়ঙ্কর। অবশ্যই। কিন্তু সেই হিংস্রতা পৌরুষের তৈরি। যে পৌরুষের ধারণা দিয়ে তাকে বেঁধে ফেলা হয়েছে। কত ভাবেই না সে বন্ধন তৈরি হয়, লালিত হয়! সিনেমায়, সিরিয়ালে, বিজ্ঞাপনে, সর্বত্র তার জয়জয়কার। হাতের ‘মাস্ল’, মুঠোর বন্দুক, এ-সব তো আছেই, কিন্তু সবার ওপরে, সবার আগে আছে ক্ষমতা এবং আধিপত্যের অনন্ত খিদে আর তেষ্টা। আর ঠিক সেই কারণেই, মেয়েরা যখন সত্যিই এগিয়ে যাচ্ছে, বেরিয়ে পড়ছে, তখন পুরুষ হিংস্র হয়ে পড়ছে।
হিংস্র হয়ে পড়ছে পৌরুষ। |