বহু বৎসর এমন বড়দিন চাক্ষুষ করে নাই ভারত। উৎসবের আনন্দ আছে, কিন্তু তাহার সহিত রহিয়াছে এক পরিব্যাপ্ত ক্ষোভ এবং প্রতিবাদের পরিবেশ। উৎসবের প্রাণবিন্দু যুবসমাজ বিক্ষুব্ধ, প্রতিবাদী। গণধর্ষণ ও পুলিশি নিষ্ক্রিয়তার বিরুদ্ধে সপ্তাহকাল ধরিয়া মুখর তাহারা। আর তাহারই পাশাপাশি রহিয়াছে এক গভীর উদ্বেগ এবং সহমর্মিতার পরিবেশও। বিক্ষোভ আন্দোলনের প্রবল দাপটে সেই বাস্তবটি হয়তো চোখে পড়িতেছে কম, কিন্তু তাহার মূল্য অপরিসীম। বস্তুত, সেই সহমর্মিতা প্রতিবাদ ও বিক্ষোভকেও প্রেরণা এবং শক্তি দিয়াছে। প্রায় শুরু হইতেই দেশ জুড়িয়া বহু মানুষ আক্রান্ত তরুণীর আরোগ্য কামনায় প্রার্থনায় বসিয়াছেন। জাতি, ধর্ম বা অন্য পরিচয় নির্বিশেষে। প্রাক্-বড়দিনের সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতির গলায়ও শোনা গেল এই সহমর্মিতার আহ্বান। জাতির উদ্দেশে প্রচারিত শুভেচ্ছাবার্তায় তিনি আক্রান্ত তরুণীর দ্রুত আরোগ্যের জন্য প্রার্থনা করিবার আহ্বান জানাইয়াছেন দেশবাসীকে। ইহা নিশ্চয়ই আনুষ্ঠানিক বিবৃতি। কিন্তু ইহাকে নিছক আনুষ্ঠানিক একটি বিবৃতি বলিয়া ধরিয়া লইলে সহমর্মিতার অমর্যাদা হইবে।
বড়দিনের প্রার্থনায় অত্যাচারিতের আরোগ্য কামনায় সর্বজনকে আহ্বান জানাইবার একটি বিশেষ তাৎপর্য খুঁজিয়া লওয়া যায়। খ্রিস্টধর্মের মূল সুরটিই ‘ভালবাসা’। ‘ঈশ্বর’ এবং ‘ভালবাসা’ দুইটি ধারণাই খ্রিস্টধর্মে পাশাপাশি উচ্চারিত হয়। ঈশ্বরের পুত্ররূপে যিশু মানবদের মধ্যে ভালবাসার বাণী বিতরণ করিয়াছেন। ভগবানকে কেবলমাত্র ভক্তি বা ভয় করাই নয়, তাহাকেও যে ভালবাসা যায়, এবং বিনিময়ে ঈশ্বরের নিকট হইতে নিছক করুণা বা দয়া নহে, সেই ভালবাসাই পাওয়া যায়, এমনটি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে সচরাচর স্বীকৃত হয় নাই, বিশেষত খ্রিস্ট-পূর্ব অতীতে। বড়দিনের প্রাক্কালে রাষ্ট্রপতি ভবন হইতে সম্ভবত একে অপরের প্রতি ভালবাসার সেই ভাবনাটিই প্রকারান্তরে দেশবাসীকে স্মরণ করাইয়া দেওয়া হইল।
এই বার্তাটি প্রায় বিস্মৃত হইতে বসিয়াছে সমাজ। মানুষ ভাবিতে অভ্যস্ত হইয়া পড়িয়াছে যে, বাকি পৃথিবীর যাহা হয় হউক, নিজ ঘরটি যেন সুরক্ষিত থাকে, তাহার গায়ে যেন আঁচড়টি না পড়ে। সেই প্রেক্ষিতে সম্পূর্ণ অপরিচিত এক তরুণীর জন্য নিজ নিজ আরাধ্যের নিকট প্রার্থনায় বসিয়াছে সমগ্র দেশ, ইহা বড় আশার কথা। তরুণীর ব্যক্তিপরিচয়, ধর্ম, পরিবার ইত্যাদির ঊর্ধ্বে গিয়া তাঁহাকে নিকটজন ভাবিয়া মেডিক্যাল বুলেটিন-এর দিকে চাহিয়া রহিয়াছে কাশ্মীর হইতে কন্যাকুমারী। ইহা সর্বজনীনতা। জাতীয়তাবাদ বা আন্তর্জাতিকতাবাদের যে সব নিদর্শন সচরাচর বইয়ের পৃষ্ঠায়, চলচ্চিত্রের পর্দায় বা খেলার মাঠে অথবা রণভূমিতে, ইহা তাহা হইতে স্বতন্ত্র এক সর্বজনীনতা। খণ্ডিত এবং বিচ্ছিন্ন অস্তিত্বের সীমা অতিক্রম করিয়া বৃহত্ত্বের সন্ধান জারি রাখিতে চাহিলে এই সর্বজনীনতাকে সযত্নে ও সসম্মানে বরণ করিতে হইবে। অনুসরণও। |