সরকারের নাকি ঘুম ভাঙিয়াছে। প্রধানমন্ত্রী প্রতিশ্রুতি দিয়াছেন, মহিলা এবং শিশুদের নিরাপত্তার সমস্ত দিক সবিশেষ বিবেচনা করা হইবে; মহিলাদের জন্য বিশেষ ‘হেল্পলাইন নম্বর’ তৈরি হইয়াছে; গণপরিবহণ-কর্মীদের পরিচয়পত্র পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হইয়াছে; পুলিশি নজরদারি বাড়াইবার সিদ্ধান্ত হইয়াছে; রাতে অধিকসংখ্যক বাস চালাইবার আশ্বাস পাওয়া গিয়াছে। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দিল্লির প্রধান বিচারপতির নিকট আবেদন করিয়াছেন, যেন এই ধর্ষণের মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তি হয়। বস্তুত, সব ধর্ষণের মামলারই যাহাতে দ্রুত বিচার হয়, তাহার জন্য বিশেষ ফাস্ট ট্র্যাক আদালতের কথা আলোচিত হইতেছে। তৎপরতা শুধু সরকারি মহলেই নহে। রাজনীতিকরা স্বপ্রবৃত্ত হইয়া জানাইতেছেন, তাঁহাদের এত নিরাপত্তার প্রয়োজন নাই। তাঁহাদের নিরাপত্তারক্ষীর সংখ্যা কমাইয়া যেন সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বৃদ্ধি করা হয়। দেখিয়া মনে হওয়া স্বাভাবিক, ভারত বুঝি জাগিয়া উঠিল। মহিলাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করিতে যাহা করা প্রয়োজন, সবই নূতন বৎসর পড়িবার পূর্বেই সারিয়া ফেলা হইবে। এই সদিচ্ছার মরসুমে একটি অপ্রিয় প্রশ্ন উত্থাপন করা প্রয়োজন এই কাজগুলি যে করা প্রয়োজন, তাহা বুঝিতে এত দিন সময় লাগিল কেন? সরকার কেন এই ধর্ষণ এবং তাহার পরবর্তী জনরোষের অপেক্ষায় ছিল? ভারতের শহরে, গ্রামে, মরুভূমিতে, পাহাড়ে, অরণ্যে মহিলাদের বিশেষ নিরাপত্তার প্রয়োজন, কারণ এই সমাজ তাঁহাদের সম্মান করিতে শিখে নাই এই কথাটি নেতারা এত দিন বুঝিতে পারেন নাই? প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তরে বোধের এমন অভাব জাতির পক্ষে সুসংবাদ নহে।
অবশ্যকর্তব্যে গাফিলতি ভারতীয়দের স্বভাবগত। এই ক্ষেত্রেও তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। দিল্লিতে জনসংখ্যার তুলনায় পুলিশকর্মীর সংখ্যা নিতান্ত কম। শুধু দিল্লিই নহে, দেশের প্রায় সব শহরেই কম। যেখানে অফিসার-পিছু অন্তত ৭ জন কনস্টেবল থাকা উচিত, সেখানে দিল্লিতে এই অনুপাত ১:৪.৬। গোটা দেশে অনুমোদিত ২০ লক্ষ পুলিশ পদের এক-চতুর্থাংশ অর্থাৎ ৫ লক্ষ পদে নিয়োগ হয় নাই। ফলে শহরে, জনপদে যে সকল স্থান অপেক্ষাকৃত নির্জন এবং অপরাধের আশঙ্কাপ্রবণ, সেখানে পুলিশি টহলের ব্যবস্থা থাকে না। রব উঠিয়াছে, নেতাদের নিরাপত্তা রক্ষা করিতে এত বেশি পুলিশ খরচ হইয়া যায় যে সাধারণ মানুষের ভাগে আর কিছুই পড়ে না। সত্য, নেতাদের জন্য নিরাপত্তার বাড়াবাড়ি হয়। তাঁহাদের জন্য কত পুলিশকর্মী নিযুক্ত হইলে যথার্থ হইবে, যুক্তিনিষ্ঠ ভাবে সেই আলোচনা হউক। তাঁহাদের যে নিরাপত্তা প্রয়োজন, দেওয়া হউক। কিন্তু তাহার অর্থ ইহা নহে যে সাধারণ মানুষের আর পুলিশ জুটিবে না। অধিকতর পুলিশ নিয়োগ করিতে হইবে। তাহাতে খরচ হইবে। কিন্তু সেই খরচ করাই সরকারের কাজ এবং কাজটি শহরের সৌন্দর্যায়ন অপেক্ষা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এই মামলাটির দ্রুত নিষ্পত্তি চাহিয়া দিল্লি আদালতের প্রধান বিচারপতির দ্বারস্থ হইয়াছেন। শুধু এই মামলাটিই কেন? বহু-আলোচিত বলিয়া? প্রতিটি মামলারই দ্রুত ফয়সলা হওয়া প্রয়োজন। ২০১১ সালে ইংল্যান্ডে বেশ বড় মাপের দাঙ্গা হইয়াছিল। সেই দাঙ্গায় অভিযুক্তদের শনাক্ত করা, তাহাদের বিরুদ্ধে তদন্ত করিয়া বিচারান্তে শাস্তি ঘোষণা সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি শেষ হইতে এক মাস সময় লাগিয়াছিল। তাহাতে তদন্তের বা বিচারের গুণগত ক্ষতি হয় নাই। এই মাপকাঠিতে দেখিলে ভারতীয় বিচারবিভাগ অতি শ্লথ। নেতারা তাহার গতিবৃদ্ধির কথা ভাবেন না কেন? ফের খরচের প্রসঙ্গ উঠিবে। বলা হইবে, যত মামলা জমিয়া আছে, সেই তুলনায় বিচারকের সংখ্যা অনেক কম, আদালত নাই ইত্যাদি। বিচারের সম্যক ব্যবস্থা নাই, এই অজুহাতটি নিতান্ত অচল। পরিকাঠামো না থাকিলে তাহার ব্যবস্থা করিতে হইবে। দায়িত্ব সরকারের। যে কোনও সভ্য দেশের সরকার যে কাজগুলি স্বপ্রবৃত্ত হইয়া করে, ভারতে তাহার জন্য বহু নৃশংস ধর্ষণের অপেক্ষায় থাকিতে হয়; যে কাজগুলি সবার আগে সারিয়া ফেলা বিধেয়, তাহার দাবিতে সংবাদপত্রে এই সম্পাদকীয় লিখিতে হয় ভারত এই লজ্জা কোথায় রাখিবে? |